দ্রুত বিবর্তনশীল ভাইরাসের দাপটে নাজেহাল পৃথিবী আজ এক নতুন আশার দিকে তাকিয়ে – অ্যান্টিবডি থেরাপি। প্রচলিত ভ্যাকসিন অনেক সময় পরিব্যক্তির বাধায় হোঁচট খায়। তখন অ্যান্টিবডি-ভিত্তিক চিকিৎসা, প্রতিরোধ-পরিকল্পনাকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, গবেষকরা এমন সব অ্যান্টিবডি তৈরি করছেন যা একদিকে ভাইরাসের বিবর্তনের পথ অনুসরণ করতে পারবে, অন্যদিকে সংক্রমণকে “নিষ্ক্রিয়” করে দিতে পারবে। এই থেরাপির লক্ষ্য হল, শরীরের ভেতর নিজস্ব ঘাঁটি গেড়ে বসার আগেই ভাইরাসকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া। ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও, দ্রুত রূপ বদলানো ভাইরাসের ক্ষেত্রে এগুলির কার্যক্ষমতা কমে যায়। এখানেই অ্যান্টিবডি থেরাপি নতুন সমাধান হিসেবে সফল। এই থেরাপিতে মানুষের শরীরের প্রতিরোধক্ষম কোষ থেকে পাওয়া প্রাকৃতিক অ্যান্টিবডি বা জিন-কারিগরিতে তৈরি অ্যান্টিবডি ব্যবহার করা হয়। এগুলি ভাইরাসের নির্দিষ্ট অংশে (এপিটোপ) গিয়ে, ভাইরাসকে ‘অচল’ করে দেয়। ইদানীং H5N1 বার্ডফ্লু নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা এখন এমন অ্যান্টিবডি তৈরি করছেন যা এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, এই অ্যান্টিবডিগুলি ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে লেগে থেকে তার সংক্রমণ ক্ষমতা অনেকটাই কমিয়ে দেয়। এইচ আই ভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে এ লড়াই আরও জটিল। এ ভাইরাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তার দ্রুত পরিব্যক্ত হওয়ার ক্ষমতা। ফলে ভ্যাকসিন অনেক সময় কার্যকর হয় না। এখানেই বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিবডি থেরাপির ওপর ভরসা রাখছেন। কারণ, এটি ভাইরাসের আশ্রয় কোষে প্রবেশের আগেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। কিছু পরীক্ষামূলক অ্যান্টিবডি ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে যে, এগুলি এইচ আই ভি-র প্রতিরূপ তৈরি বন্ধ করতে সক্ষম। অ্যান্টিবডি থেরাপির পিছনে রয়েছে অত্যাধুনিক গবেষণা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি। যেমন ফেজ ডিসপ্লে লাইব্রেরি, মানবায়িত মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি কিংবা একক বিটা কোষ থেকে অ্যান্টিবডি ক্লোনিং। এই সব পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে নির্ভুল অ্যান্টিবডি চিহ্নিত করতে সাহায্য করছে। এই প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা একরকম ‘জৈব বন্দুক ’ তৈরি করছেন, যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে পারে। এ সাধারণ ওষুধের তুলনায় অনেক বেশি নিখুঁত, তবে তৈরির খরচও বেশি। থেরাপিটি এখনও গবেষণাগার থেকে ক্লিনিকাল প্রয়োগের পথে হাঁটছে। সফলতা সত্ত্বেও নানা বাধা রয়ে গেছে – ভাইরাসের নতুন রূপকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা বজায় রাখা, অ্যান্টিবডি দিয়ে চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, সর্বোপরি দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই থেরাপি একা সংক্রমণ নির্মূলনের চাবিকাঠি নয়, বরং ভ্যাকসিন ও অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের সঙ্গে সমন্বিত প্রয়োগেই এর সর্বোচ্চ সাফল্য আসবে। বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই অনেক ওষুধ কোম্পানি ও গবেষণাগার এই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। চিকিৎসাবিদরা বলছেন, এই থেরাপি ভবিষ্যতে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ‘দ্রুত সাড়াদায়ী অস্ত্র’ হিসেবে কাজ করবে। যেমন কোনো ভাইরাসে নতুন পরিব্যক্তি দেখা দিলে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে ঠেকানোর অ্যান্টিবডি সংস্করণ তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত প্রভৃতি জনবহুল দেশে ভাইরাল সংক্রমণ প্রায়শই মহামারীর রূপ নেয়। অ্যান্টিবডি থেরাপির মতো লক্ষ্যভেদী চিকিৎসা এখানে সহজলভ্য হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন স্থানীয় স্তরে গবেষণা, উৎপাদন এবং সাশ্রয়ী বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, “অ্যান্টিবডি থেরাপি এখনই শেষ কথা নয়, তবে এটি ভবিষ্যতের চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অপরিহার্য অধ্যায় হয়ে উঠছে।“ প্রতিরোধ মানে শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, ভাইরাস বিবর্তিত হওয়ার আগেই রোগকে থামিয়ে দেওয়া।
সূত্র: Antibody drugs show promise for treating bird flu and HIV Scientists are developing antibodies to track the evolution of these viruses and better treat infections. By Rachel Fieldhouse; 05 November 2025.
