ভুয়ো তথ্যে জর্জরিত পরিবেশনীতি  

ভুয়ো তথ্যে জর্জরিত পরিবেশনীতি  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩ নভেম্বর, ২০২৫

যেকোনো বিষয়ক নীতির শক্তি তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার উপর নির্ভর করে। সাম্প্রতিক কয়েকমাস ধরে ভারতের দুটি বড় পরিবেশ পর্যবেক্ষণ প্রকল্প এমন সব প্রশ্ন তুলেছে যা কেবল প্রযুক্তি নয়, শাসনব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিফলন। যথা- ১) দিল্লির বাস্তব বায়ুদূষণ নেটওয়ার্ক এবং ২) লখনৌর জাতীয় শব্দদূষণ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা। দুটি প্রকল্পই শুরু হয়েছিল জাঁকজমকপূর্ণভাবে। কিন্তু এখন প্রমাণিত যে বৈজ্ঞানিক ত্রুটি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার দরুন এই সিস্টেমগুলো কার্যত জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। যখন তথ্যই অবিশ্বস্ত, তখন নীতি আর কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে?

দীর্ঘদিন ধরেই প্রমাণিত যে ভারতের শহরগুলোর বায়ুর মান শ্বাস নেওয়ার অযোগ্য, আর দিল্লি এই তালিকায় সবচেয়ে নীচে। দিল্লীর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্কে সি এ জি- র সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা গেছে, সেন্সর বসানো হয়েছে গাছের নীচে, দেয়ালের আড়ালে বা এমন স্থানে যেখানে বাতাসের সঠিক পরিমাপই পাওয়া যায় না। আরও আশ্চর্যের বিষয়, সরকার নতুন সেন্সর বসাতে চাইছে তুলনামূলক কম দূষিত এলাকায়, যাতে রিপোর্টে বায়ুর মান দেখায় মধ্যম। অথচ নাগরিকেরা বাস্তবে বিষাক্ত ধোঁয়ায় হাঁপিয়ে উঠছেন। এতে শুধু তথ্য নয়, গোটা শাসনব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে। যখন তথ্য বিকৃত বা অসম্পূর্ণ হয়, তখন শুধু নীতিই নয়, তার দিকনির্দেশনাও ভুল পথে চলে যায়। দুর্বল পর্যবেক্ষণব্যবস্থা ভারতের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বিপন্ন করে তুলছে। যেমন, প্যারিস চুক্তি বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র বায়ুমান মানদণ্ড। সবকিছুতেই দেখা গেছে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সূক্ষ্ম ধূলিকণা (PM2.5) শ্বাসযন্ত্র দুর্বল করে, চোখের দৃষ্টিশক্তির পর্যন্ত ক্ষতি করে।

 

দিল্লির মতোই, লখনৌর শব্দদূষণ নেটওয়ার্কও ব্যর্থ হয়েছে তার উদ্দেশ্য সাধনে। ২০১৭ সালে সাতটি বড় শহরে শব্দমাত্রা সরকার নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে যায়। কারণ মনিটরিং যন্ত্রগুলোই ছিল ত্রুটিপূর্ণ , আসল শব্দমাত্রা ঠিকভাবে মাপতে ব্যর্থ। ফলে, সরকারী রিপোর্টে দেখাচ্ছে স্বাভাবিক মাত্রা, আর বাস্তবে কতো মানুষ হারাচ্ছেন নিদ্রা, মানসিক শান্তি ও শ্রবণশক্তি। সেই বছর সংসদে তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী অনীল মাধব দাভে শহুরে শব্দদূষণ নীতির দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। উপরন্তু, দেশে এখনো চলছে পুরনো শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রক বিধি 2000, যা আজকের শহুরে বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই নয়। এই আইনে নির্ধারিত ডেসিবেল সীমা হু -এর মানদণ্ডের চেয়ে অনেক শিথিল, শাস্তির ব্যবস্থা দুর্বল, আর প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে।

আজ ভারতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে দেখানোর জন্য,বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা বা স্বচ্ছতার জন্য নয়। ফলত, বাস্তবের চেয়ে কম দূষণ দেখানো হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ।প্রযুক্তি এখন প্রহসন হয়ে উঠেছে। চকচকে সেন্সর আর গ্রাফের পেছনে লুকিয়ে আছে বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলার অভাব। এই ভুল তথ্য শুধু মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করছে না, আদালতকে পর্যন্ত বিভ্রান্ত করছে। দিল্লিতে ন্যায্য বিচার বিলম্বিত হয়, আর লখনৌতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার (সংবিধানের ১৯ ও ২১ অনুচ্ছেদ) ক্ষুণ্ন হয়। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত স্বীকার করেছে শব্দদূষণ এখন শুধু একটা অসুবিধা নয়, এ এখন এক জনস্বাস্থ্য ও সাংবিধানিক সমস্যা।

সি পি সি বি-এর নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলে দেওয়া আছে যে, সেন্সর কোথায় বসবে, কীভাবে ক্যালিব্রেশন হবে, কত ঘন ঘন অডিট হবে। সবই শুধু কাগজে।

বাস্তবে এর প্রয়োগ শিথিল, রাজনৈতিক চাপ প্রবল, আর নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক যাচাই কার্যত অনুপস্থিত।

এতে জনগণের বিশ্বাস ভেঙে পড়ছে।অথচ, বিশ্বমান অনুযায়ী যদি দিল্লির বায়ু হু – এর মানে পৌঁছায়, মানুষের গড় আয়ু বাড়তে পারে ৮.২ বছর। আজ দূষণ ভারতের মানুষের গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে গড়ে পাঁচ বছর করে, অথচ বিকৃত তথ্য জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিকে “মডারেট”বলে আড়াল করছে। নাগরিকদের স্বাস্থ্য নিয়ে এমন প্রতারণা সত্যিই ভয়াবহ।

লেখকদ্বয় রোহন সিং ও কুশাগ্র রাজেন্দ্রর মতে, এই সংকট কেবল যন্ত্র বা সেন্সরের নয়, মানুষের শ্বাস, শিশুর ফুসফুস, বৃদ্ধের ঘুম, সর্বোপরি নাগরিকের জীবনের।ভুল তথ্য মানে শিশুদের ফুসফুসে বিষ ঢোকানো, প্রবীণদের শ্রবণশক্তিকে শব্দের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করা। তাই এখন সময় এসেছে বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে নতুন বিশ্বাসযোগ্য তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার—স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের হিসাবনিকাশ ও জনগণের তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জনগনের আস্থা—এই তিনটিকেই হতে হবে ভারতের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ বিপ্লবের মেরুদণ্ড।

 

সূত্র: Unreliable air and noise data, real-time deception by Rohan Singh & Kushagra Rajendra, Published on The Hindu website on Oct 22, 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − 1 =