
ভূমিকম্প নামটা শুনলেই চোখের সামনে যে দৃশ্যটা ফুটে ওঠে সেটা হল – হঠাৎ মাটি কেঁপে ওঠা, ঘরবাড়ি ধ্বসে পড়া আর জলাশয়গুলোর উত্তাল জলোচ্ছ্বাস। কিন্তু সম্প্রতি এমআইটির একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, ভূমিকম্পে বেরিয়ে আসা বিপুল শক্তির মাত্র ১০ শতাংশ কম্পনে রূপান্তরিত হয়। ভাঙন বা নতুন চ্যুতি তৈরিতে ব্যয় হয় ১ শতাংশেরও কম। প্রায় ৮০ শতাংশ শক্তিই তাপে রূপান্তরিত হয়, যা অনেক সময় এতটাই প্রবল যে মুহূর্তের মধ্যে শিলা গলে কাচের মতো হয়ে যায়।
এই গোপন শক্তির হিসাব বের করতে এমআইটির ভূবিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন “ল্যাব ভূকম্প ”। একে প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের একপ্রকার ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে। গবেষকরা ছোট ছোট গ্রানাইট শিলা নমুনা চাপের মধ্যে রেখে তাতে সেন্সর ও চৌম্বক কণার সাহায্যে শক্তি বণ্টন মাপেন। চৌম্বক কণাগুলো তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তাদের চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তন করে, যা তাপ উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণে সহায়তা করে। একই সঙ্গে চাপ বা কম্পনকে বিদ্যুৎ সংকেতে রূপান্তরকারী বিশেষ পাইজোইলেকট্রিক সেন্সর দিয়ে কম্পন রেকর্ড করা হয়।
পরীক্ষায় দেখা যায়, ভূমিকম্পের ক্ষুদ্র সংস্করণেও শক্তির একটা বড় অংশ ঘর্ষণজনিত তাপে রূপান্তরিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে শিলা মাত্র মাইক্রোসেকেন্ডে ঘরের তাপমাত্রা থেকে ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায় এবং দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে পুনরায় কঠিন আকার ধারণ করে। এমনকি কিছু নমুনায় দেখা গেছে, চ্যুতি এক ঝটকায় ১০ মিটার/সেকেন্ড গতিতে সরে গেছে।প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দ্রুত কিন্তু অল্পস্থায়ী।
প্রকৃত ভূমিকম্পেও শক্তির বণ্টন এমনভাবেই হয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। অর্থাৎ আসলে বাস্তবে ভূমিকম্পে বেরিয়ে আসা শক্তির তুলনায় কম্পন খুবই সামান্য। আমরা তো কেবল কম্পনটুকুই অনুভব করি, তাপ ও ভাঙনের মতো মস্ত ঘটনা আমাদের চোখের আড়ালে ঘটে যায় গভীর ভূগর্ভে। গবেষকদের মতে, শিলার অতীত স্মৃতি, অর্থাৎ পূর্বের ভূ-ত্বকীয় চাপ ও বিকৃতি নির্ধারণ করে দেয় ভবিষ্যতে ভূমিকম্প কতটা তীব্র হবে।
এই ল্যাব-ভিত্তিক গবেষণা প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের জটিলতা পুরোপুরি ধরতে না পারলেও ভৌত প্রক্রিয়াটিকে সহজভাবে বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার ফলস্বরূপ আশা করছেন, অতীতের কোনো ভূমিকম্পে কতটা কম্পন হয়েছিল তা জানা থাকলে হয়তো অনুমান করা সম্ভব হবে বাকি শক্তি কীভাবে শিলাকে গলিয়েছে বা ভেঙেছে। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে সেই অঞ্চল ভবিষ্যতে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
মোটকথা হল ভূমিকম্প মানেই শুধু কাঁপন নয়। ভূগর্ভে তখন তৈরি হয় অদৃশ্য বহ্নিশিখার তাণ্ডব, যা পৃথিবীর ভেতরের কাঠামোকে কখনো ভেঙে কখনো আবার গড়ে নতুন করে সাজায়।আর ভূগর্ভের এই বিপুল তাপই ভূমিকম্পের আসল শক্তি, যা আমরা ভূপৃষ্ঠের উপরে দাঁড়িয়ে টেরই পাই না।
সূত্র: “Lab-Quakes”: Quantifying the Complete Energy Budget of High-Pressure Laboratory Failure” by Daniel Ortega-Arroyo, Hoagy O’Ghaffari,et.al;(28.08.2025), AGU Advances.
DOI: 10.1029/2025AV001683