ভূ-কম্প গবেষণায় অভিনব গাণিতিক কৌশল 

ভূ-কম্প গবেষণায় অভিনব গাণিতিক কৌশল 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

ভূমিকম্প কখন আঘাত হানবে, এই প্রশ্নের নির্ভরযোগ্য উত্তর বিজ্ঞান আজও দিতে পারে না। কখন, কোথায় এবং কতটা তীব্রতায় এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় আঘাত হানবে—তা আজও বিজ্ঞানের কাছে রহস্যই রয়ে গেছে। তবে অপ্রত্যাশিত হলেও ভূমিকম্পের প্রভাব একেবারে অজানা নয়। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে, উন্নত গণিতভিত্তিক মডেল ও দ্রুতগতির কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে পৃথিবীর পৃষ্ঠের নীচের গঠন আরও স্পষ্টভাবে বোঝা সম্ভব হচ্ছে, যা ভূমিকম্পের ঝুঁকি মূল্যায়নে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করতে পারে।

২০২৫ সালের ৬ই ডিসেম্বর আলাস্কায় রিখটার স্কেল অনুসারে ৭.০ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এমন বড় ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে বিরল হলেও, ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প সারা পৃথিবীতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক সংস্থা ইউএসজিএসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫৫টি ভূমিকম্প হয়—যার মোট সংখ্যা বছরে প্রায় বিশ হাজার। সাধারণত প্রতিবছর একটি ভূমিকম্প ৮.০ বা তার বেশি মাত্রায় পৌঁছায়, আর প্রায় ১৫টি ভূমিকম্প থাকে ৭ মাত্রার আশেপাশে। ২০২৫ সালে রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপের কাছে সংঘটিত ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে।

ভূমিকম্পের প্রভাব শুধু তাৎক্ষণিক প্রাণহানি বা অবকাঠামো ধ্বংসেই সীমাবদ্ধ নয়; এর দীর্ঘস্থায়ী মানসিক আঘাত এবং বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি সমাজকে বহু বছর ধরে বহন করতে হয়। সব মিলিয়ে এর প্রভাব বহুমাত্রিক।

ইউএসজিএস ও ফিমার -এর ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিকম্পজনিত বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪.৭ বিলিয়ন ডলার। জানা গেছে এই সংখ্যা নাকি ক্রমশ বাড়ছে, কারণ আগের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ এখন ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে বসবাস করছে।

ভূমিকম্পের আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভূ-অভ্যন্তরের গঠন। কোথাও শক্ত শিলা, কোথাও বালু বা কাদামাটির স্তর—এই পার্থক্যের কারণে ভূকম্পীয় তরঙ্গের গতি ও রূপ বদলে যায়, যার প্রভাব ভূপৃষ্ঠে ভিন্নভাবে অনুভূত হয়। এই কারণেই বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন ফুল ওয়েভফর্ম ইনভার্সন নামের একটি উন্নত সিসমিক ইমেজিং পদ্ধতি। এতে কম্পিউটারে কৃত্রিম ভূমিকম্প সৃষ্টি করে ভূকম্পীয় তরঙ্গের বিস্তার বিশ্লেষণ করা হয় এবং তা বাস্তব ভূমিকম্পের সিসমোগ্রাম ডেটার সঙ্গে তুলনা করা হয়।

তবে এই পদ্ধতির বড় সীমাবদ্ধতা হলো এর বিপুল গণনাগত ব্যয়। হাজার হাজার সিমুলেশন চালাতে হয়, যেখানে একটি সিমুলেশনই শক্তিশালী কম্পিউটারে কয়েক ঘণ্টা সময় নিতে পারে। এই সমস্যার সমাধানে স্টিভেন্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গণিতবিদ ক্যাথরিন স্মেটানা ও তাঁর আন্তর্জাতিক সহযোগীরা একটি নতুন ক্ষুদ্রতর মডেল তৈরি করেছেন। এই মডেল সিস্টেমের আকার প্রায় এক হাজার গুণ ছোট করে দেয়, অথচ পূর্বাভাসের নির্ভুলতা বজায় রাখে।

যদিও এই পদ্ধতি সরাসরি ভূমিকম্পের সময়ের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না, তবে এটি ভূমিকম্পের ঝুঁকি মূল্যায়ন, এমনকি ভবিষ্যতে সুনামি সিমুলেশনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কম খরচে ও কম সময়ে ভূ-অভ্যন্তরের বাস্তবসম্মত চিত্র পাওয়া গেলে, সমাজ আরও ভালোভাবে ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে। কম্পিউটারের ক্ষমতা ও গণিতের সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার এই মিলন মানবসমাজকে আরও ভূমিকম্প-সহনশীল করে তুলতে পারে। এটাই এই গবেষণার সবচেয়ে বড় সাফল্য।

সূত্রঃ “Model Order Reduction for Seismic Applications” by Rhys Hawkins, Muhammad Hamza Khalid, Matthias Schlottbom and Kathrin Smetana, 17 September 2025, SIAM Journal on Scientific Computing.

DOI: 10.1137/24M1667737

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 + seven =