
কথাতে যেন মধু ঝরে পড়ছে, মধুর কণ্ঠস্বর, মধুর মতো মিষ্টি, মধুর আমার মায়ের হাসি, জন্মের সময় মা বোধহয় মধু দেয়নি মুখে, মধু খাবেন রোজ সকালে এক চামচ, … এরকম অনেক কথা আমরা বলি বা শুনি । এই মধু মৌমাছির (honeybee) তৈরি মধু আর তার সঙ্গেই তুলনা । কিন্তু আমরা কতটুকু জানি এই মধু সম্পর্কে, আর কেনই বা এর মিষ্টতা বা গুণ নিয়ে কথা বলি অথবা তুলনা করি? এই মধুর বোধহয় কোনো বিকল্প কিছু নেই বা কৃত্রিমভাবে এটা তৈরী করা সম্ভব নয়, আর হলেও সেটার সাথে এই মৌচাকের মধুর তুলনা (স্বাদে ও গন্ধে বা গুণে) করা অহেতুক ভুল হবে ।
আমি ছোটোবেলা থেকে, মানে ক্লাস ফাইভ থেকে শুরু করে কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়া পর্যন্ত মৌমাছি পালন করেছি, ওদের পাশে থেকেছি। শীতকালে যখন ফুল থাকত না, ওদের জমানো মধুও শেষ হয়ে যেত, তখন ওদের চিনির জল খেতে দিতাম । সে এক বিশেষ ধরনের অভিজ্ঞতা, যা ঠিক বলে বা লিখে বোঝাতে পারবো না, দেখতে হয় বা অনুভব করতে হয় । ওদের জীবনটা এতই সাজানো গোছানো যে তা লিখতে গেলেও মনে হয় অনেক কিছু বাকি থেকে যাবে । আমিও যেমন ওদের ভালবাসতাম ঠিক তেমনি ওরাও। আমি ওদের গায়ে হাত দিয়েছি (চাপ না দিয়ে) সরে গেছে, কখনও দু হাত বেয়ে উঠে এসেছে । না, বিঁধে নি । বিনা কারণে ওরা হুল ফোটাতে আসতো না । কিন্তু আমার অসাবধানতায় বহু বার হুল ফুটিয়েছে, প্রথম প্রথম ভীষণভাবে ফুলে যেতো । ওরা বেশী চোখে মুখে নিশানা করত, কতবার একচোখ ফুলে বন্ধ হয়ে গেছে, সেই অবস্থায় স্কুলে গিয়েছি । তারপর আস্তে আস্তে সয়ে গেল। ওই লাল পিঁপড়ে কামড়ালে যেমন হয় তেমনি হতো । অনেককে দেখছি পূর্ণ সুরক্ষা নিয়ে কাজ করতে, যেমনটা কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় ডাক্তাররা পরে থাকেন। আমি তা করিনি কখনো , কেবল আমার সাথে ধোঁয়া দেওয়ার জিনিস থাকতো । আজও ভীষণ ভাবে ওদের অভাব বোধ করি। যারা মৌমাছি পালন করেছে তারা হয়তো জানে এগুলো । আমি যতটা দেখেছি, জেনেছি বা শিখেছি সেটা লেখার চেষ্টা করছি ।
মৌমাছিরা দলবদ্ধ ভাবে থাকে । একটা মৌচাকে তিন প্রকারের মৌমাছি ( প্রায় ১ মিলিয়ন ) থাকে-
১) একটি মাত্র রানী মৌমাছি , তাঁকে দেখতে অতীব সুন্দর , শরীরটাও বড় অন্যদের তুলনায়। শত শত মৌমাছিদের মধ্যেও রানীকে চেনা যায় । এর কাজ ডিম পাড়া (দিনে ১০০০ থেকে ২০০০ টা ডিম পাড়তে পারে)। বাসা থেকে সচরাচর বের হয় না । কিন্ত যখন দেখে যে আরও একটা রানী জন্ম নিতে চলেছে তখন এই বয়স্কা রানী কিছু শ্রমিক মৌমাছি নিয়ে পুরানো বাসা ছেড়ে চলে যায়, আর ফেরে না। অন্য কোথাও গিয়ে বাসা খুঁজে নেয় । অর্থাৎ সে নতুন রানীকে জায়গা ছেড়ে দেয় আর কিছু শ্রমিক মৌমাছিকে সব বুঝিয়ে দিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেয়।
২) পুরুষ মৌমাছি। এদের সম্পর্কে সেভাবে কিছু বলার নেই । দেখতে কালো, একটু মোটা । দলে এদের সংখ্যা কম, তবে বসন্ত কালে এদের দেখা যায় । প্রজনন ছাড়া এর কোন কাজ নেই । হুল ফোটাতে পারে না । বসে বসে খায় আর বিকালে বের হয় খেলবার জন্য । শ্রমিক মৌমাছিরা বিকালে নবজাতকদের নিয়ে যখন বাসা থেকে বের হয়, এরাও তাদের সাথে বের হয়। বেশী দূর যায় না, ১০ থেকে ২৫ ফুটের মধ্যে থাকে । আর কিছু না, নবজাতককে ওড়া শেখানোর ছোট্ট ট্রেনিং।
৩) এরপর আসি তাদের কথায় দলে যাদের অবদানের তুলনা হয় না, সেই শ্রমিক শ্রেণীর কথায়। এরা বন্ধ্যা স্ত্রী মৌমাছি। বাসা তৈরি থেকে শুরু করে ফুল থেকে খাবার সংগ্রহ করা, ডিম বা লার্ভাদের সময় মতো খেতে দেওয়া, বাসা পাহারা দেওয়া, সব করে এরা। রানী যখন একটার পর একটা ডিম পাড়ে (প্রতিটি ছয় কোনা কুঠুরিতে), তখন কতকগুলো শ্রমিক চারদিক থেকে একটা বৃত্ত করে ঘিরে থাকে । মনে হয় রানীকে হাওয়া করছে নিজেদের ডানা দিয়ে । রানীও একের পর এক ডিম পাড়তে থাকে আর এদের বৃত্তটাও এগিয়ে চলে ।
এই শ্রমিকরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে যায়। নানা ধরনের কাজ। এদের মধ্যে মারামারি হতে দেখিনি। আবার সবাই একসাথে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় না, তাহলে একমাত্র রানীকে কে পাহারা দেবে ? পুরুষ মৌমাছি তো শ্রমিকও নয় আর সৈনিকও নয় । সব কাজ এই শ্রমিকশ্রেণীর মৌমাছিদের করতে হয় । এরা একের পর এক বের হতে থাকে, আবার কিছু মৌমাছি খাবার সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ফিরে আসতে থাকে । যাওয়া আসা লেগেই থাকে । তাই বাসা কখনোই শ্রমিক/সৈনিক বিহীন হয় না । কোনো বোলতা বা টিকটিকি বাসার কাছে এলে এরা দলবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করে । একটা মৌচাকের মৌমাছি অন্য মৌচাকে ঢুকতে পারে না, মনে হয় এরা কোনো ভাবে সেটা গন্ধে অনুভব করতে পারে । আর ঢুকতে গেলেই মারামারি শুরু করে । মূলত দলবাজি! এই মৌমাছি হুল ফোটালে একটা বিশেষ গন্ধ পাওয়া যায়, সাথে সাথে অন্য মৌমাছিরাও বুঝতে পারে কোনো শত্রু আক্রমণ করেছে। তখন ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে এসে আক্রমণ চালায় । যে মৌমাছি হুল ফোটাবে সে মারা যাবে । পরিবারকে বাঁচানোর জন্য আত্মঘাতী আক্রমণ! আবার কোনো মৌমাছি মারা গেলে তাকে নিয়ে দূরে কোথাও ফেলে আসে । পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসে । শীতকাল খুব একটা পছন্দ করে না , আবার খুব গরমও সইতে পারে না। ওদের বাসা থেকে বের হওয়ার হার দেখে জেনেছি । খুব সৌখীন ভাবে থাকতে চায় । যখনই সময় পেয়েছি পড়া শেষে বা কাজের ফাঁকে তখনই মৌমাছিদের কাছে গিয়ে বসে বসে ওদের আসা যাওয়া আর কাজকর্ম দেখতাম । এই ছোট প্রাণী বা পতঙ্গের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি বা শেখার রয়েছে । এরা অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী আর খাটিয়ে। শুধুমাত্র ফুল থেকেই যা কিছু পায় সেটা দিয়ে আর মুখের লালা দিয়ে তৈরি করে সুন্দর ছয় কোনা বাসা, বায়ো পলিমার দিয়ে। আমি এই মোম দিয়ে মোমবাতি বানিয়ে জ্বলিয়েছি।
আজ দীর্ঘ ২৮ বছর আমেরিকাতে থেকেও সেই গ্রামের কথা মনে পড়ে । কত কিছুই না করতাম ! পাঁশকুড়ার এক গ্রামে আমার বাড়ি । আজ যে এতসব লিখছি মৌমাছিদের নিয়ে, তা কিন্তু আমার বাবা আর দাদার কাছ থেকে জানা বা পাওয়া। বাবা ছিলেন শিক্ষক, দাদা তখন কলেজে, তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্যে দেশ-বিদেশ । আমার উপর সব দায়িত্ব পড়লো । আমাদের ২০-২২ টা Honeybee বসতি ছিল। প্রতিটা মৌমাছির দল এক একটা কাঠের বাক্সতে থাকে। শখের বলুন আর ব্যবসাই বলুন, মধু খেয়ে আর পাড়া প্রতিবেশীদের বিলিয়েও প্রতি বছর প্রায় ২০০ কেজি মধু সংগ্রহ করে মৌমাছি পালন সমিতিতে খুব অল্প দামে বিক্রি করতাম । আর ওই সমিতি থেকে অল্প টাকায় মৌমাছি পালন করার কাঠের বাক্স, মধু সংগ্রহ করা জন্য যন্ত্র প্রভৃতি কিনতাম। এগুলো হাতে চালানো গিয়ার ড্রাম লাগানো। কেন্দ্রমুখে অভিসারী সেন্ট্রিফিউগাল বল প্রয়োগ করে কেবলমাত্র মধু নিকাশ করা হয়। পুনরায় ব্যবহার্য খালি মৌচাকগুলো আবার মৌমাছিদের বাক্সতে রাখা হয়, যাতে মৌমাছিরা আবার মধু রাখতে পারে। এ নিয়ে পরে আবার কখনও বিশদভাবে জানবো।
যখন যে ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করতো সেই সময় আমি মধু চাক থেকে বের করতাম। তাতে করে কোনটা আম মুকুলের মধু আর কোনটা সর্ষে ফুলের মধু বা নিম ফুলের মধু, সব আলাদা করতাম। বিভিন্ন ধরনের ফুলের মধুর বিভিন্ন স্বাদ আর ঘনত্ব। যেমন সজনে ফুলের মধু সবথেকে ভালো, সাদা আর অনেক বেশি ঘন, সান্দ্র। সর্ষে ফুলের মধু অনেকটাই জলীয়। আবার স্বাভাবিক ভাবেই নিম ফুলের মধু একটু তেতো। মৌচাক সহ মধু খেতে ভীষণ ভালো লাগে ।
মনে আছে আমাদের বাড়িতে কাঁচের বোতলে এই কাঁচা মধু বছরের পর বছর থাকতো কোনোরকম প্রেসার্ভেটিভ ছাড়া। স্বাদ বা গন্ধের কোনো রকমফের হতো না ।
আমার মতে, এখনই এই প্রজাতিটির সংরক্ষণ নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার । কৃষকরা যেভাবে চাষাবাদে অতিরিক্ত পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করছেন, তাতে মৌমাছিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে । যদি কৃষকরা ফুল ফোটার সময়টিতে কীটনাশক ব্যবহার এড়িয়ে চলেন, বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করেন, অথবা এমন কীটনাশক ব্যবহার করেন যা মৌমাছিদের জন্য ক্ষতিকর নয়—তাহলে দু’পক্ষই উপকৃত হবে। একদিকে পরাগায়ন সুষ্ঠুভাবে হবে, কৃষিতে অধিক ফলন হবে, অন্যদিকে মৌমাছিরাও নিরাপদে মধু সংগ্রহ করে বেঁচে থাকতে পারবে। মৌমাছিরা জঙ্গলের ফুলের উপর বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু সেই জঙ্গল আজ উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে ।বনের গাছ-পালা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে । ইকো-সিস্টেম নষ্ট হয়ে পড়ছে ।
যদি এই প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে আমাদের কৃত্রিম মধুর উপর নির্ভর করতে হবে, এবং কৃষি উৎপাদনেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তাই আসুন আমরা সবাই সচেতন হই ।
[19/07, 5:46 pm] Prof Krishnendu Sengupta (IACS-Bhatnagar Awardee): শুভময় শিবেশের লেখার মাধ্যমে বিজ্ঞানভাষ সম্মন্ধে জানলাম। খুব regular পত্রিকা। Well done. Keep it up.
[19/07, 6:59 pm] Subhamay Dutta: Thank you Krishnendu-দা।