মলাহারী -মৃতভোজী গুবরে পোকা

মলাহারী -মৃতভোজী গুবরে পোকা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

প্রকৃতিতে রয়েছে ছোট্ট অথচ অবিশ্বাস্যভাবে কার্যকর এক পরিষ্কারক দল। যাদের আমরা চিনি মলভোজী গুবরে পোকা বা ডাং বিটল নামে। গবাদি পশুর মল থেকে শুরু করে বন্য প্রাণীর বর্জ্য- সবকিছু পরিষ্কার করে তারা পৃথিবীর জীবচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সম্প্রতি উন্মোচিত কিছু তথ্য এই প্রচলিত ধারণাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। কোটি কোটি বছর আগে এই পোকাগুলির একাংশ কেবল পশুর মল নয়, বরং মৃত প্রাণীর পচা মাংসও খাওয়া শুরু করেছিল। অর্থাৎ,এরা বিবর্তনের পথে ধীরে ধীরে এক নতুন খাদ্যাভ্যাসে অভিযোজিত হয়েছে। ‘মলভোজী ’ থেকে ‘মাংসভোজী’তে রূপান্তরিত হয়েছে। গবেষকরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন গুবরেদের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, প্রায় ৩৭ কোটি বছর আগেই এই পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটেছিল। তখনকার পৃথিবীতে বৃহৎ প্রাণীদের মৃত্যুর পর তাদের দেহ দ্রুত পচে যেত আর সেটাই কিছু প্রজাতির গুবরেদের জন্য পুষ্টির নতুন উৎস হয়ে উঠত। “খাদ্যপ্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে এই পতঙ্গরা নতুন সুযোগ খুঁজে নেয়। মৃত প্রাণীর দেহ তখন একরকম ‘অস্থায়ী ভোজভূমি’, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তুলনামূলকভাবে কম।”

প্রথমদিকে এই পতঙ্গরা সম্ভবত বৃহৎ তৃণভোজী প্রাণীর মল থেকেই পুষ্টি পেত।কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ বদলেছে, প্রাণীর প্রজাতিও পরিবর্তিত হয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যচক্রে নতুন সুযোগ তৈরি হয়। সেই পরিবর্তনের স্রোতে কিছু গুবরে নিজেদের মানিয়ে নেয় মৃতদেহের পচনশীল পদার্থের উপর নির্ভরশীল হয়ে। এই অভিযোজন কেবল খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন নয়। এ এক গভীর বিবর্তনী কৌশল। মৃতদেহে পুষ্টির ঘনত্ব অনেক বেশি, কিন্তু তা অল্প সময়ের জন্যই পাওয়া যায়। তাই এই পতঙ্গদের মধ্যে দ্রুত গন্ধ শনাক্ত করা, মৃতদেহের কাছে দ্রুত পৌঁছে যাওয়া, এবং ডিম পাড়ার জন্য সঠিক স্থান নির্বাচন করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায়, এই পতঙ্গদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা মৃতদেহ ও বর্জ্য ভেঙে মাটিতে ফিরিয়ে দেয়। ফলে মাটির জৈব উপাদান বৃদ্ধি পায় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। বিজ্ঞানীরা একে একধরনের প্রাকৃতিক পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, “যদি পৃথিবীতে মলাহারী ও মৃতদেহভোজী পতঙ্গ না থাকত, তবে মাত্র কয়েক বছরেই আমাদের চারপাশে পচা মৃতদেহ ও বর্জ্যের স্তূপ জমে যেত, এবং জীবনচক্র থমকে যেত।“দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিল, মল গুবরেদের খাদ্যাভ্যাস স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মল থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু নতুন জীবাশ্মপ্রমাণ দেখাচ্ছে, তাদের উৎপত্তি আরও পুরোনো। ডাইনোসরের যুগ পর্যন্ত পৌঁছে যায় এই কাহিনী। প্রাচীন সরীসৃপদের মল ও দেহাবশেষই সম্ভবত প্রথম খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই আবিষ্কার আমাদের এক মৌলিক সত্যের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়- বিবর্তন কেবল বড় বড় প্রাণীর মধ্যেই ঘটে না, ক্ষুদ্র জীবদের মধ্যেও প্রকৃতির অভিযোজন প্রবণতা সমানভাবে কাজ করে।খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা, পরিবেশের পরিবর্তন, আর বেঁচে থাকার কৌশল—সবই একসাথে গড়ে তোলে জীবনচক্রের নতুন রূপ। প্রকৃতিতে কোনো কিছুই “অপ্রয়োজনীয়”নয়। মৃতদেহ বা মল, যেগুলিকে আমরা সাধারণত ঘৃণা করি, সেগুলিই প্রকৃতির পুনর্জীবনের ভিত্তি। এই ক্ষুদ্র গুবরেরা সেই অদৃশ্য পুনর্জীবন প্রক্রিয়ার নীরব স্থপতি, যাদের অবদান ছাড়া পৃথিবী হয়তো শ্বাস নিতে পারত না।

 

 

সূত্র : How poop-eating beetles evolved to eat rotting flesh

Analysis of thousands of fossils pushes back change in beetles’ diets by more than 37 million years; 17 Oct 2025; ByTaylor Mitchell Brown;

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen + nineteen =