বয়স বাড়লেও মন যেন থাকে তরতাজা, স্মৃতি যেন থাকে তীক্ষ্ণ—এই স্বপ্নের সফরে সামিল হয়েছেন একদল মার্কিন গবেষক। তাঁদের মতে, মস্তিষ্কের তারুণ্য ধরে রাখার চাবিকাঠি হয়তো লুকিয়ে আছে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে।
তাঁদের নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ চর্বিযুক্ত কিন্তু নিম্ন কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাদ্যাভ্যাস, অর্থাৎ কিটোজেনিক ডায়েট, মস্তিষ্কের কোষকে সক্রিয় রাখতে পারে এবং আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দিতে পারে।
এই ডায়েটে প্রধানত থাকে মাছ, মাংস, ডিম, বাদাম, বীজ, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার এবং উচ্চ চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য। চিনি বা ময়দাজাত খাবার একেবারেই কম থাকে। ফলে শরীর শক্তি তৈরি করে গ্লুকোজ নয়, চর্বি থেকে , আর সেই শক্তির উৎস হলো কিটোন— যা মস্তিষ্কের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।
মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আই-লিং লিন এবং পিএইচ ডি গবেষক কিরা ইভানিচ এক বিশেষ জিন APOE4-এর উপর এই গবেষণা চালিয়েছেন। এই জিন হলো আলঝেইমার রোগের সবচেয়ে বড় জিনগত ঝুঁকি উপাদান, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে।
তাঁরা ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখেছেন, যেসব স্ত্রী ইঁদুরের দেহে APOE4 জিন রয়েছে, কিটোজেনিক ডায়েট খাওয়ার পর তাদের অন্ত্রে প্রচুর সুস্থ ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়েছে এবং মস্তিষ্কে শক্তি উৎপাদনও বেড়েছে। কিন্তু পুরুষ ইঁদুরদের মধ্যে একই ফল দেখা যায়নি। অর্থাৎ, এই ডায়েটের প্রভাব লিঙ্গ ও জিনগত পার্থক্যের ওপর নির্ভরশীল।
সাধারণত আমরা কার্বোহাইড্রেট খেলে শরীর গ্লুকোজ তৈরি করে, আর সেটিই মস্তিষ্কের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যাদের APOE4 জিন আছে, বিশেষ করে নারীরা, তারা এই গ্লুকোজকে সঠিকভাবে মস্তিষ্কে ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশ বা মানসিক অবনতি দেখা দেয়।
ইভানিচ বলেন, কিটোজেনিক ডায়েট করলে শরীরে কিটোন তৈরি হয়, যা মস্তিষ্কের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কাজ করতে পারে। এতে মস্তিষ্কের কোষের মৃত্যু কমে এবং আলঝেইমার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
গবেষক লিনের মতে, একটি নির্দিষ্ট খাদ্য বা চিকিৎসা সবার জন্য কার্যকর হবে এমনটা ভাবা ভুল। মানুষের জিন, অন্ত্রের অণুজীব সমষ্টি বা মাইক্রোবায়োমে বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী আলাদা পুষ্টি কৌশল দরকার। তিনি বলেন, আলঝেইমারের উপসর্গ সাধারণত ৬৫ বছরের পর দেখা যায়, তাই প্রতিরোধমূলক যত্ন শুরু হওয়া উচিত তার অনেক আগেই। এই আবিষ্কার কেবল খাদ্য নয়, ব্যক্তিকৃত পুষ্টিবিজ্ঞানের নতুন দিকও উন্মোচন করছে।
এই গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে রয় ব্লান্ট নেক্সটজেন প্রিসিশন হেলথ বিল্ডিংয়ে, যেখানে অত্যাধুনিক ব্রেইন ইমেজিং যন্ত্র এবং গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল সুবিধা একই ছাদের নীচে রয়েছে। অধ্যাপক লিন বলেন, এটি কোনো নির্দিষ্ট গবেষকের কাজ নয়, দলগত বিজ্ঞানের জয়। একসঙ্গে কাজ করলে প্রভাব অনেক গভীর হয়।
গবেষক কিরা ইভানিচ জানান, তাঁর দিদা বা ঠাকুমার মধ্যে কেউ একজন আলঝেইমারে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাই এই গবেষণায় কাজ করতে পারা তাঁর কাছে ব্যক্তিগতভাবে এক বিশাল তৃপ্তির বিষয়।
এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অফ নিউরোকেমিস্ট্রিতে। যেখানে বলা হয়েছে, কিটোজেনিক ডায়েট APOE4 জিন ও লিঙ্গভিত্তিকভাবে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য পরিবর্তন করে, যা ভবিষ্যতের আলঝেইমার প্রতিরোধে নতুন আশা জাগাচ্ছে।
এই ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে চর্বিকে ভয় না-পেয়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে তা হতে পারে মস্তিষ্ককে তরুণ রাখার মোক্ষম হাতিয়ার।
সম্ভবত একদিন, আলঝেইমার প্রতিরোধের মূল পন্থাই হবে কম চিনি, বেশি চর্বি, আর একটু সচেতনতা।
সূত্র: “Ketogenic Diet Modulates Gut Microbiota–Brain Metabolite Axis in a Sex- and Genotype-Specific Manner in APOE4 Mice” by Kira Ivanich,Aaron Ericsson and Ai-Ling Lin,et.al; (1.09.2025), Journal of Neurochemistry.
DOI: 10.1111/jnc.70216
