
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ ভাবছে, কীভাবে তার মস্তিষ্ক অন্যান্য বানরের থেকে আলাদা।সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানুষের মস্তিষ্কে এমন বিশেষ কিছু স্নায়ু সংযোগ আছে, যা শিম্পাঞ্জি বা অন্য বানরদের মধ্যে দেখা যায় না।এই বিশেষ সংযোগগুলো আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক বুদ্ধিমত্তা ও ভাষাগত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগিয়ার মার্স এবং আইক্স-মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাথেরিন ব্রায়ান্ট ।আগের গবেষণা অনুযায়ী আমাদের চিন্তা করা, মনোযোগ দেওয়া এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মূলত পুরোমস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।নতুন গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু চিন্তা নয়, বরং আবেগ ও সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও মানুষের মস্তিষ্কের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। অনুভূতি বোঝা, অভিব্যক্তি বোঝা বা নানা সামাজিক সংকেতের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মানুষের মস্তিষ্ক অন্য প্রাণীদের তুলনায় ভিন্নভাবে কাজ করে ।এরই সুবাদে আমরা দলবদ্ধতা , ন্যায়নীতি বোধ এবং আবেগকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি।গবেষণায় বোঝা যায় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স আমাদের পরিকল্পনা করা ও সমস্যা সমাধানের মতো জটিল কাজ করতে সাহায্য করে।বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে মনে করতেন এই দক্ষতাগুলোই মানুষকে অন্য বানরজাতীয় প্রাণীদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে।এখন গবেষকরা বলছেন, শুধু চিন্তাশক্তি নয়, বরং আবেগ শেখার ক্ষমতাও মানুষের উন্নত আচরণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।বুদ্ধি ও আবেগের এই মিশেলই আমাদের সত্যিকারের মানুষ করে তোলে।শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মানুষের ডিএনএর ৯৮শতাংশর বেশি মিল থাকার কারণে আমরা অনেকটাই একই রকম।তবে, ২০১৫ সালের আগে করা মস্তিষ্কের স্ক্যান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানুষ ও শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের কিছু পার্থক্য রয়েছে।এই পার্থক্যের মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ, আবেগের গভীরতা ও সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত বিশেষ সংযোগ।শিম্পাঞ্জি, বাঁদর ও মানুষের মস্তিষ্ক তুলনা করে গবেষকরা খুঁজে বের করছেন কোন নির্দিষ্ট মস্তিষ্কের সংযোগ আমাদের আলাদা করেছে।মস্তিষ্কের টেম্পোরাল ও প্যারিয়েটাল লোব এমন কিছু কাজ করে যা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর তথ্যকে একসঙ্গে যুক্ত করা, ঘটনার সঙ্গে প্রসঙ্গ মেলানো এবং উন্নত ভাষা -দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের এই বিশেষ সংযোগগুলো পরীক্ষা করে দেখেছেন, কোন জিনিসটি শুধু মানুষের মধ্যেই সক্রিয় থাকে।গবেষকদের মতে, এই বিশেষ অংশগুলোই আমাদের জটিল সামাজিক সম্পর্ক গড়তে, ভাষার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত বুঝতে এবং নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। এই গবেষণার ফলাফলকে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হলে আরও ভালোভাবে বোঝা যায় যে মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে দৈনন্দিন জীবনে কাজ করে।গবেষণায় দেখা গেছে, টেম্পোরাল লোবের বিশেষ কিছু অংশ ভাষার সাথে জড়িত, যেখানে শব্দের উচ্চারণ ও অর্থ বোঝার প্রক্রিয়া ঘটে।এই সংযোগগুলোর কারণেই আমরা হাজারো শব্দ শিখতে, সেগুলোকে বাক্যে গুছিয়ে বলতে এবং জটিল ধারণা সহজে প্রকাশ করতে পারি।শক্তিশালী ভাষাগত সংযোগ থেকে বোঝা যায় যে আমাদের যোগাযোগ কেবল সাধারণ শব্দের আওয়াজ থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভাষার এই উন্নতি কোনো একক “ভাষা জিন” থেকে আসেনি, বরং বিভিন্ন স্নায়ুর জটিল সংযোগের পরিবর্তনের ফলে সম্ভব হয়েছে।গবেষকরা বলছেন মানুষের বিশেষত্ব শুধু পুরোমস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের জন্যই নয়, আমাদের আবেগ ও সামাজিক সম্পর্ক বোঝার ক্ষমতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে মানুষ শুধু যুক্তিবাদী চিন্তার জন্যই অনন্য নয়, বরং আবেগ ও সামাজিক সংযোগও আমাদের পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।ভবিষ্যতে, বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের এই বিশেষ সংযোগগুলো আমাদের জীবনকালে কীভাবে পরিবর্তিত হয় এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এর কোনো ভিন্নতা আছে কি না এই বিষয়ে গবেষণা করতে পারেন।
এই ধরনের গবেষণা থেকে জানা যেতে পারে যে আমাদের মস্তিষ্ক কতটা বদলাতে পারে এবং কীভাবে আমাদের সহানুভূতি, ভাষা ও সমাজবোধের বিকাশ ঘটে।প্রতিটি গবেষণা আমাদের মস্তিষ্কের জটিলতা বুঝতে নতুন পথ তৈরি করে। এমন গবেষণাগুলো মনে করিয়ে দেয় যে মানুষের বুদ্ধিমত্তা কোনো একক মস্তিষ্কের অংশের ওপর নির্ভর করে না, বরং অনেক সংযোগের সমন্বয়ে গঠিত।গবেষকরা মনে করেন, খাদ্যাভ্যাস, দলগত জীবনযাপন ও সরঞ্জাম ব্যবহার মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছে।প্রাচীন জীবাশ্ম ও জিনসম্পর্কিত গবেষণা থেকে বোঝা যায় কীভাবে ও কবে এসব পরিবর্তন ঘটেছে।প্রাচীন খুলি পরীক্ষা করে জানা যেতে পারে, ভাষা ও সামাজিক দক্ষতা মস্তিষ্কের আকারের পরিবর্তনের সঙ্গে কীভাবে গড়ে উঠেছে।এই গবেষণা জেনিউরোস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।