মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণকারী কীট! তাদের মধ্যে কিছু জিন অনুপস্থিত

মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণকারী কীট! তাদের মধ্যে কিছু জিন অনুপস্থিত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ জুলাই, ২০২৩

পর্ব নিমাটোফোরা গোষ্ঠীর হেয়ারওয়ার্ম বহুল প্রাপ্ত একটা কৃমি, সরু চকচকে অনেকটা লালচে রঙয়ের নুডলস- এর মতো দেখতে। প্রকৃতির এক আশ্চর্য বিষয় হল, এর কোনো শ্বসন তন্ত্র, রেচন তন্ত্র এমনকি সংবহনতন্ত্র ও নেই, এটা জীবনের বেশিরভাগ সময় পরজীবী হিসাবে অন্য প্রাণীর মধ্যে কাটায়। তুয়ানা কুনহা, শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়ামের একজন পোস্টডক্টরাল গবেষক এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় করা গবেষণার প্রধান লেখক এক অদ্ভুত বিষয় জানিয়েছেন, যে এই পরজীবী প্রাণী তার পোষকের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে দিয়ে এমন কাজ করায়, যেটা সেই পোষক প্রাণী সাধারণ অবস্থায় করবে না।
মিষ্টি জলে হেয়ারকৃমির কয়েকশ প্রজাতি থাকে। তারা জলে ডিম পাড়ে, তার থেকে লার্ভা নির্গত হলে জলে বসবাসকারী মেফ্লাই হেয়ারকৃমির সেই লার্ভা খায়, যা হেয়ারকৃমিও নিজেই চায়। এই লার্ভা খাওয়া মেফ্লাই যখন ডাঙায় যায়, তখন ঝিঁঝিঁ পোকা আবার সেই মেফ্লাই শিকার করে খায়। ব্যস! হেয়ারকৃমি এবার তার নতুন পোষকদের দেহের অভ্যন্তরে সময়ের সাথে সাথে প্রাপ্তবয়স্ক হতে থাকে, আর পোষকের শরীর থেকে চর্বি খেতে থাকে, আর নিজেদের মধ্যে মিলিত হতে থাকে। ঝিঁঝিঁ পোকা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। ধীরে ধীরে হেয়ারকৃমি ঝিঁঝিঁপোকাকে জলের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এমনিতে ঝিঁঝিঁ পোকা জলে সাঁতার কাটতে পারেনা, যার ফলে তারা জলে যেতে চায় না। কিন্তু যে ঝিঁঝিঁ পোকার শরীরের অভ্যন্তরে হেয়ারকৃমির বাস, তারা হেয়ারকৃমির একটা রাসায়নিক ক্ষরণে জলের দিকে যায়, আর শেষে জলে ঝাঁপ দেয়। সেখানে, পূর্ণ হেয়ারকৃমিগুলো ঝিঁঝিঁ পোকার পশ্চাদভাগ থেকে বেরিয়ে এসে জলে সাঁতার কাটতে থাকে এবং সঙ্গীদের সন্ধান করে, নিজেদের জীবন চক্র নতুন করে শুরু করে। এছাড়াও পাঁচ প্রজাতির হেয়ারকৃমি রয়েছে যেগুলো সামুদ্রিক পরিবেশে বাস করে এবং গলদা চিংড়ির মতো জলে বসবাসকারী প্রাণীগুলিকে পোষক বানায়, তবে সেই হেয়ারকৃমি পোষককে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করে কিনা তা পরিষ্কার নয়, কারণ কীটদের জলে ফিরে যাওয়ার জন্য আলাদা কোনও চাপ নেই পোষকরা সেখানেই বাস করে।
কুনহা এবং তার সহকর্মীরা মিষ্টি জল এবং নোনা জলের দুটি হেয়ারকৃমির প্রজাতি থেকে ডিএনএ নমুনা নিয়ে তাদের জেনেটিক সেকোয়েন্সিং করেছেন৷ তারা হেয়ারওয়ার্মের জেনেটিক কোডগুলিকে অন্যান্য প্রাণীদের সাথে তুলনা করে দেখেছেন উভয় হেয়ারওয়ার্ম জিনোমেই প্রায় ৩০% জিনের সেট অনুপস্থিত ছিল যা মূলত সমস্ত প্রাণীর গ্রুপে উপস্থিত থাকে।
অন্যান্য প্রাণী গোষ্ঠীতে এই অনুপস্থিত জিনগুলি কী কাজ করে তা জানাতে গিয়ে কুনহা এবং সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে তারা সিলিয়া তৈরির নির্দেশনা দেয়। সিলিয়া হল ছোটো রোমশ উপাঙ্গ, যা সমস্ত প্রাণী, প্রোটিস্টা, কিছু গাছপালা এবং ছত্রাকের মধ্যে উপস্থিত। এগুলো মানবদেহের কোষেও উপস্থিত থাকে, যেমন শুক্রাণু কোষের লেজের মতো অংশ সিলিয়াযুক্ত, চোখের রেটিনা কোষেও সিলিয়া থাকে। তারা বলেছেন, হয়তো এর পরজীবী আচরণের জন্য সিলিয়া বিবর্তিত হয়ে লুপ্ত হয়েছে, কারণ বিভিন্ন পরজীবী প্রাণীতে কিছু কিছু শারীরিক অংশ ব্যবহার না করতে করতে বিবর্তিত হয়ে লুপ্ত হয়ে যায়।
কুনহা বলেছেন যে হেয়ারওয়ার্ম- ই একমাত্র এমন প্রাণী নয় যারা মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। টক্সোপ্লাসমা গন্ডি থেকে টক্সোপ্লাসমোসিন নির্গত হয়, যার থেকে ইঁদুর সংক্রামিত হলে তার বিড়ালের গন্ধ থেকে যে ভয় উৎপন্ন হয় তা কেটে যায়। আবার অফিওকর্ডিসেপস ছত্রাক পিঁপড়েকে তার স্পোর ছড়ানোর কাজে লাগায়। কুনহা বলেছেন তাদের নতুন গবেষণা হেয়ারওয়ার্মের আচরণের পিছনে সাধারণ সুত্র খুঁজে পেতে বিজ্ঞানীদের সহায়তা করতে পারে। ভবিষ্যতে বিভিন্ন জীবের মধ্যে এই নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে তাদের আচরণের বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × 2 =