মহাকাশের প্রান্তস্পর্শী হুঙ্গা অগ্ন্যুৎপাত 

মহাকাশের প্রান্তস্পর্শী হুঙ্গা অগ্ন্যুৎপাত 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

সাধারণত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকে ভূমি ও মহাসাগরে। কিন্তু খুব বিরল কিছু ক্ষেত্রে এসব বিস্ফোরণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গভীর স্তর ভেদ করে উপরের স্তরগুলোতেও প্রভাব ফেলে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে সংঘটিত হুঙ্গা টোঙ্গা–হুঙ্গা হা’পাই অগ্ন্যুৎপাত ছিল এমনই এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। এটি কার্যত মহাকাশের প্রান্ত স্পর্শ করে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ও রসায়নে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন এনেছে।

অগভীর সমুদ্রের নীচে অবস্থানের কারণে, হুঙ্গার ম্যাগমা ও সমুদ্রজলের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ থেকে সৃষ্টি হয় অত্যন্ত শক্তিশালী বিস্ফোরণ। এর ফলে ম্যাগমা ভেঙে অতি সূক্ষ্ম কণায় পরিণত হয় এবং বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার পেরিয়ে মেসোস্ফিয়ারের কাছাকাছি স্তর পর্যন্ত উঠে যায়। উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ, আবহাওয়া বেলুন, বিমানভিত্তিক পরিমাপ এবং ভূমিভিত্তিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই অস্বাভাবিক উল্লম্ব বিস্তার নিশ্চিত করেছেন।

আন্তর্জাতিক গবেষণা মূল্যায়ন অনুযায়ী, অগ্ন্যুৎপাতের পর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা আধুনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পের একটা বড় অংশ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বস্তরে স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে। পূর্ববর্তী কোনো অগ্ন্যুৎপাতের ক্ষেত্রে এত দীর্ঘস্থায়ী আর্দ্রতা বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সাধারণত বিশাল অগ্ন্যুৎপাত বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরকে উষ্ণ করে তোলে, কারণ ছাই ও কালো কণা সূর্যালোক শোষণ করে। তবে হুঙ্গার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি ছিল আলাদা। অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প মহাকাশে তাপ বিকিরণ করে দেওয়ায়, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের বিস্তৃত অঞ্চলে তাপমাত্রা ০.৫ থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হ্রাস পায়। এই শীতল প্রভাব ধীরে ধীরে আরও উঁচু স্তরেও ছড়িয়ে পড়ে, যা স্পষ্টত ১৯৯১ সালের পিনাটুবো অগ্ন্যুৎপাতের অভিজ্ঞতার বিপরীত।

যদিও হুঙ্গা অগ্ন্যুৎপাতের ম্যাগমায় সালফারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ছিল, সমুদ্রজলের উপস্থিতি সেই সালফারের বড় অংশকে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশে বাধা দেয়। ফলে সালফেট অ্যারোসলের মোট পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এর কারণে পৃথিবীর পৃষ্ঠে তাপমাত্রা পরিবর্তন ছিল সীমিত—মাত্র ০.০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাভাবিক পরিসরের মধ্যেই পড়ে।

অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প সাময়িকভাবে দক্ষিণ গোলার্ধে ওজোন স্তরে কিছু পরিবর্তন আনলেও, অ্যান্টার্কটিকার ওজোন ক্ষয় স্বাভাবিক সীমার মধ্যেই ছিল। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, হুঙ্গা অগ্ন্যুৎপাত দেখিয়ে দিয়েছে যে সমুদ্রতলীয়, জলসমৃদ্ধ অগ্ন্যুৎপাত কীভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বায়ুমণ্ডলের স্মৃতি বহন করতে পারে।

সমগ্র বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, হুঙ্গা টোঙ্গা–হুঙ্গা হা’পাই অগ্ন্যুৎপাত বায়ুমণ্ডল ও জলবায়ু ব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের উপলব্ধিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। একই সঙ্গে দেখিয়েছে, বিরল হলেও এমন ঘটনাগুলো বোঝার জন্য বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ ও আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা কতখানি অপরিহার্য।

 

সূত্র: The Hunga Volcanic Eruption Atmospheric Impacts Report by Zhu, Y., Mann, G., published in the journal Forschungzentrum Jülich, 22nd December2025.

doi:10.34734/FZJ-2025-05237

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × 3 =