মহাকাশে অশান্ত চৌম্বক দশা

মহাকাশে অশান্ত চৌম্বক দশা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২০ মে, ২০২৫

আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যে তারাগুলির মাঝখানের পরিসরে আছে গ্যাস আর কণার মস্ত মস্ত মেঘপুঞ্জ। সেই পরিসরে চুম্বকায়িত অশান্ত দশাকে আগের তুলনায় ঢের বিস্তারিতভাবে বোঝবার জন্য বিজ্ঞানীরা জার্মানির SuperMUC-NG কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে একটি নতুন মডেল তৈরি করেছেন। এই মডেলে এমনভাবে সিমুলেশন প্রক্রিয়া চালানো হয় যাতে চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো মহাকাশের দূর পরিসরে কীভাবে অশান্ত গ্যাসের আচরণকে রূপ দেয় সেই প্রক্রিয়াটা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো যায়। এই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো বাড়ির রেফ্রিজারেটরের চুম্বকের চেয়েও বহু মিলিয়ন গুণ কম শক্তিশালী। অথচ গ্যালাক্সির চেহারা কেমন হবে, কীভাবে নক্ষত্র তৈরি হবে, সে ব্যাপারে এই অতি দুর্বল ক্ষেত্রগুলির বেশ একটা বড়ো ভূমিকা আছে। দূর মহাকাশের অশান্ত দশা সম্বন্ধে জানতে পারলে হয়তো নক্ষত্র আর গ্যালাক্সির উদ্ভব সংক্রান্ত বহুদিনের অসমাধিত প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে সুবিধে হবে।
সাবেকি বলবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড়ো অসমাধিত প্রশ্নর মধ্যে একটা হল এই অশান্ত দশা। অথচ অশান্ত দশা সর্বত্র হাজির। কফিতে দুধ ঢালা থেকে শুরু করে মহাসাগর, সৌর ঝঞ্ঝা, আন্তঃ-নাক্ষত্রিক মাধ্যম, এমনকি গ্যালাক্সিদের অন্তর্বর্তী প্লাজমা, সবখানেই রয়েছে এই এলোমেলো স্রোত। এই নতুন মডেলের বৃহত্তম সংস্করণটি ৩০ আলোক-বর্ষব্যাপী বিশাল পরিসরকে সিমুলেট করতে পারে। তবে এর আসল শক্তি হল নমনীয়তা। বিজ্ঞানীরা এর কর্মশীলতার মাত্রাকে ৫০০০ গুণ কমিয়ে নিয়ে অনেক ছোটোখাটো পরিঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। যেমন সৌর ঝঞ্ঝা, যা সূর্য থেকে নির্গত হয়ে পৃথিবীকে প্রভাবিত করে। একথা ঠিক যে, পৃথিবীর তুলনায় মহাকাশকে প্রায় শূন্যই বলা চলে। কিন্তু মহাকাশের পরিসরে ওইসব কণাদের গতিই চৌম্বক ক্ষেত্র আর অশান্ত দশার জন্ম দেয়। পৃথিবী গ্রহের কেন্দ্র-মজ্জায় যে গলিত পদার্থ থাকে তার চলন থেকেই যেমন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎপত্তি, মহাকাশের ক্ষেত্রগুলোও তাই। এইসব খুঁটিনাটি এই মডেলে যেভাবে ধরা পড়ে তা অভূতপূর্ব। আন্তঃ-নাক্ষত্রিক মাধ্যমের চরম পরিবর্তনগুলি এই সিমুলেশনে নিপুণভাবে দেখা যায়: একটা ধার কার্যত ফাঁকা, অন্য ধারে নীহারিকার মধ্য থেকে জন্ম নিচ্ছে তারা। তারারা কী করে জন্মায় সেই রোমাঞ্চকর ঘটনাটি এই সিমুলেশনের সাহায্যে বোঝা যায়। চৌম্বক চাপ বাইরের দিকে ছিটকে বেরিয়ে এসে অভিকর্ষকে বাধা দেয় – আর অভিকর্ষ বল চায় গ্যাস মেঘপুঞ্জকে ঠেলে ভিতরের দিকে ঘন-সংহত করে তারায় রূপান্তরিত করতে। এখন এই ধরনের ব্যাপক মাত্রায় চৌম্বক অশান্ত দশার পরিণাম কী হতে পারে তার পরিমাণাত্মক হিসাব দেওয়া সম্ভব। এমন খুঁটিনাটি সহকারে এতটা গভীরভাবে বিষয়টা বোঝার ফলে এখন বিজ্ঞানীরা আগের তুলনায় আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছেন কখন আর কীভাবে আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যে তারাগুলো গড়ে ওঠে।
বিজ্ঞানীরা সৌর ঝঞ্ঝা আর পৃথিবী সংক্রান্ত বিদ্যমান উপাত্তর সঙ্গে তত্ত্বকে যাচাই করে নিচ্ছেন। এখনো অবধি খুব ভালো ফল পাওয়া গেছে। এই সিমুলেশন থেকে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ আর মানুষের উপর যেসব আহিত (চার্জড) কণা বর্ষিত হয় তাদের সম্বন্ধে জানা যাবে। পৃথিবীর উপরেও এদের নানারকম প্রভাব পড়ে।

মোক্ষম সময়ে এই মডেলটি তৈরি হয়েছে। কারণ নানান বৈজ্ঞানিক হাতিয়ারের কল্যাণে মহাকাশে চৌম্বক অশান্ত দশা সংক্রান্ত অজস্র বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ এখন মানুষের হাতে এসে জমা হচ্ছে। ঠিক এই সময় নিখুঁত সিমুলেশনে পটু এই মডেলটি হাতে না এলে এই বিপুল পরিমাণ উপাত্তর অর্থোদ্ধার দুঃসাধ্য হত।
এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে নেচার অ্যাস্ট্রনমি পত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × four =