মহাকাশে ২৫ বছরের মানববসতি

মহাকাশে ২৫ বছরের মানববসতি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১১ নভেম্বর, ২০২৫

২০০০ সালের ২ নভেম্বর, রুশ মহাকাশযান ‘সয়ুজ’-এ করে তিনজন নভোচারী পাড়ি দিয়েছিলেন মহাকাশে। গন্তব্য আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। সেই দিন মানব ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত মহাশূন্যে একটানা ২৫ বছর মানুষের বসবাস অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কক্ষপথে পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে কেবল এক টুকরো ধাতব কাঠামো নয়, আবর্তিত হয়েছে মানুষের জ্ঞান, প্রযুক্তি, সহযোগিতা আর কৌতূহলের এক জীবন্ত প্রতীক। আজ পর্যন্ত ২৬টি দেশের প্রায় ২৯০ জন নভোচারী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গেছেন। স্টেশনটি প্রতি ৯০ মিনিটে একবার করে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। অর্থাৎ দিনে প্রায় ১৬ বার করে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায় সেখানে। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতায় ভেসে থাকা এই স্টেশন মূলত এক ভাসমান গবেষণাগার। এখানে পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে জীববিজ্ঞান, চিকিৎসা থেকে উপাদানবিজ্ঞান- সব ক্ষেত্র নিয়েই চলছে নতুন সব পরীক্ষা। মহাকাশ স্টেশন শুধু মহাকাশ গবেষণার কেন্দ্র নয়, এটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অনন্য এক উদাহরণও। এই প্রকল্পের মূল অংশীদার দেশগুলি হল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলি। এরা সবাই মিলে তৈরি করেছে এক যৌথ গবেষণার পরিকাঠামো। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা , রুশ মহাকাশ সংস্থা রসকসমস, জাপানের জাক্সা, ইউরোপের ইএসএ ও কানাডার সিএসএ- এই পাঁচটি সংস্থা মিলে স্টেশনের দৈনন্দিন কাজ, রক্ষণাবেক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনা করে চলেছে। এই ২৫ বছরে স্টেশন থেকে সংগৃহীত তথ্য বদলে দিয়েছে আমাদের মহাকাশ বিষয়ক দৃষ্টিকোণ। শূন্য মাধ্যাকর্ষণে মানবদেহে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে, উদ্ভিদ কীভাবে জন্ম নেয়, কিংবা তরল ও গ্যাস কীভাবে আচরণ করে, এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর মিলেছে এখানেই। এর পেছনে রয়েছে অগণিত প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ। মহাকাশের বিকিরণ, স্টেশনের পুরনো অংশে ক্ষয়, অক্সিজেন লিক, ক্রমবর্ধমান রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, আর চারপাশে ঘিরে থাকা মহাকাশ-আবর্জনার ঝুঁকি এইসব বিপত্তি সামলাতে হয় স্টেশনটিকে। ২০২১ সালে কয়েকটি ছোট ধাক্কায় স্টেশনটি কেঁপে ওঠে। রুশ অংশটিতে চাপের পরিবর্তন ও পুরনো যন্ত্রাংশের কারণে ক্ষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন সেই অবকাঠামো ধরে রাখা, নভোচারীদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ মিশন পরিকল্পনা নিয়েই চলছে প্রতিনিয়ত টানাপোড়েন। বর্তমানে আই এস এস-এর অবসরের সময়সীমা ২০৩০ সালের মধ্যে নির্ধারিত হয়েছে। নাসা ঘোষণা করেছে, এরপর তারা বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি নতুন কক্ষপথে স্থাপিত স্টেশনের দিকে অগ্রসর হবে যেখানে গবেষণা ও পর্যটন দুই-ই সম্ভব হবে। রাশিয়াও নিজস্ব স্পেস স্টেশন তৈরির কথা ঘোষণা করে দিয়েছে। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এই যৌথ ঘাঁটিটি হয়তো একদিন কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। তার উত্তরাধিকার বাঁচবে নতুন রূপে- বেসরকারি মহাকাশ স্টেশনে, চাঁদ ও মঙ্গল অভিযানে, এবং ভবিষ্যতের মহাকাশ অর্থনীতিতে । আই এস এস শুধুই একটি গবেষণাগার নয়, এটি মানব সভ্যতার সীমা ছাড়ানোর প্রতীক। এখানেই মানুষ প্রথমবার বুঝেছে, পৃথিবীর বাইরে থেকে পৃথিবীকে দেখা সম্ভব, এবং সেখানে কাজ করাও সম্ভব। ২৫ বছর ধরে কক্ষপথে ভেসে থাকা এই স্টেশন যেন বলছে, “মানবজাতির জিজ্ঞাসা ও সহযোগিতার শক্তি যখন একত্র হয়, তখন মহাশূন্যও হয়ে ওঠে আমাদের ঘর।”

 

 

সূত্র : The International Space Station marks 25 years of nonstop human presence in orbit; Science; 30th Oct, 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 + 18 =