মহাকাশের অতিক্ষীণ অভিকর্ষ মানুষের পেশি, হাড়, রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র, বোধবুদ্ধিকে বদলে দেয়, তা জানা ছিল। কিন্তু মস্তিষ্কের ওপর এর প্রভাব কীভাবে পড়ে? সেটা জানবার জন্য একদল বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক মহাকাশ নিবাসে মস্তিষ্ক-কোষ থেকে আহরিত ‘অর্গানয়েড’ নামে কতকগুলি স্টেম সেলের গুচ্ছ পাঠিয়েছিলেন। স্টেম সেল হল সেই আদি অবিভক্ত কোষ যা থেকে বিভিন্ন রকমের কোষ গড়ে ওঠে। এই স্টেম সেলগুলো এক মাস ধরে মহাকাশের কক্ষপথে চক্কর কেটে সুস্থ অবস্থায় পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। শুধু তাই নয়, আদি স্টেম সেল থেকে অন্যন্য কোষ গড়ে ওঠার কাজটা তারা পৃথিবী গ্রহের স্টেম সেলগুলো তুলনায় তাড়াতাড়ি করেছে। তারা পরিণত রূপ লাভ করেছে তাড়াতাড়ি। বয়োপ্রাপ্ত নিউরন হয়ে-ওঠার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে তারা। বিশেষীভূত হয়ে অন্যান্য কোষ বিভক্ত হয়ে যাওয়ার লক্ষণ তাদের মধ্যে পরিস্ফুট। স্টেম সেল্স ট্রানস্লেশনাল মেডিসিন কাগজে সম্প্রতি এইসব ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। মহাকাশ ভ্রমণের সম্ভাব্য স্নায়ুঘটিত সমস্যাদির ওপর এই গবেষণা হয়তো আলোকপাত করবে। স্ক্রিপ্স রিসার্চ সংস্থার সেন্টার ফর রিজেনারেটিভ মেডিসিনের গবেষকদলের উপ-প্রধান, অধ্যাপক জিন লরিং জানিয়েছেন, এ বিষয় নিয়ে ‘মহাকাশে ভবিষ্যৎ পরীক্ষানিরীক্ষার ভিত গড়ে দিল এই গবেষণা। মস্তিষ্কের যেসব অঙ্গ স্নায়ুক্ষয়জনিত রোগে ভোগে, সেগুলোকে এবার মহাকাশ গবেষণার অঙ্গ করে তোলা যাবে’। লরিং কয়েক দশক ধরে মস্তিষ্কের দুরারোগ্য মাল্টিপ্ল স্ক্লেরোসিস কিংবা পার্কিন্সনিজম রোগ নিয়ে ক্যাজ করেছেন। এই রোগে যাঁরা ভোগেন তাঁদের মস্তিষ্কের নিউরনগুলির বিশেষ কয়েকটি অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখান থেকেই স্টেম সেল নিয়ে তাঁর গবেষক দল এই ‘অর্গানয়েড’ বানিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল মাইক্রগ্লিয়া নামক রোগ-প্রতিরোধী কোষ, যা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বাসিন্দা। অতিক্ষীণ অভিকর্ষের পরিবেশে ওদের আর এন এ ক্রিয়ার সঙ্গে পৃথিবীতে অবস্থিত অনুরূপ অর্গানয়েড কোষের ক্রিয়ার তুলনা করেন তাঁরা। তাঁরা দেখেন, ওই অপার্থিব পরিবেশে পরিণত রূপ ধারণের সঙ্গে জড়িত জিনগুলির সংখ্যা এদের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে জড়িত জিনগুলির সংখ্যা কমেছে। আগে তাঁরা ভেবেছিলেন, ওই পরিবেশে প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) আর মানসিক চাপ-ঘটিত জিনক্রিয়া হয়তো বাড়বে। কিন্তু ঠিক তার উলটো জিনিস দেখা গেছে। তাদের ওইসব জিনক্রিয়া বরং কমেছে। কেন কমেছে, তা বলার আগে আরও অনেক গবেষণা চালাতে হবে। লরিং বলছেন, এই বৈশিষ্ট্যগুলি সম্ভবত মানুষের মস্তিষ্কেও সক্রিয় থাকে। অতিক্ষীণ অভিকর্ষের প্রভাবে পরিবেশে কোনো পরিচলন (কনভেকশন) ঘটে না, সোজা কথায়, কোনোকিছু নড়ে না। মহাকাশে অর্গানয়েডগুলোর ধর্ম অনেকটা মস্তিষ্কেরই মতো। তারা খুবই স্বাধীন। ‘তারা হয়তো মস্তিষ্কের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা রূপ গড়ে নেয়’ । মাল্টিপ্ল স্ক্লেরোসিস এবং পার্কিন্সনিজমের মতো আলঝাইমার্স-ও মস্তিষ্কের এক দুরারোগ্য রোগ। এর পর তা নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে লরিংয়ের গবেষক-দলের।