ইতিহাসের পাতা উল্টালে লিপি নিয়ে নানান আশ্চর্যের গল্প আমরা পাই। মানুষের প্রয়োজনেই সেই সব লিপি তৈরি হওয়া। এমনও লিপি পাওয়া যায়, যা সেই সময় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র মহিলাদের জন্যই লিপি? শুনেছেন কখনও?
এশিয়া মহাদেশেই একটি নির্দিষ্ট ভাষা শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য তৈরি হয়েছিল। শতকের পর শতক ধরে তার চর্চা চলে। মূলত পুরুষদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে গিয়ে মহিলাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যেই এই ভাষা এবং লিপির উদ্ভব হয়। তাই বলা যেতে পারে এই ভাষার লিপি আসলে এক ধরনের বিদ্রোহ ছিল। এই ভাষাটি হল নুশু।
চিনের দক্ষিণ-পূর্বের হুনান প্রদেশের জ্যাংইয়াং গ্রাম এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এই গোপন ভাষার উদ্ভব প্রথম ঘটেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে দশম শতকের শেষভাগে এই ভাষার প্রথম উদ্ভব হয়। তৎকালীন চিনে মহিলারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হতেন। তাঁদের যেমন পড়াশোনা করার অধিকার ছিল না, তেমন কোনও কিছুতেই নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারতেন না তাঁরা।এই পরিস্থিতিতে মহিলারা যাতে নিজেদের মত করে একটি জগত রচনা করেতে সক্ষম হয় সেই জন্যেই এই নুশু ভাষা ও লিপি প্রস্তুত হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় পথ চলার পরও এই ভাষার পরিচয় পায়নি কোনও পুরুষ। একান্তভাবেই মেয়েদের মধ্যে থেকে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। যে সমস্ত মেয়েরা নুশু ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠত তারা প্রত্যেকেই নিরক্ষর ছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে একজন নিরক্ষর মানুষ কি করে নিজের মাতৃভাষার বাইরে গিয়ে অপর একটি লিপি শিখে উঠতে সক্ষম হবে?
আসলে সেই সময় চিনের মেয়েরা বাইরে বের হতে পারত না। তাই কাজকর্মের সেরে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাঁরা ছবি আঁকার মত করে নুশু লিপি লেখা অভ্যেস করত। দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে একসময় তাঁরা চিনা ভাষা অর্থাৎ মান্দারিনে নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও নুশু লিপিতে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠত! এইভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই গোপন ভাষা চিনের মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে একবিংশ শতকের আগে পর্যন্ত মাত্র একজন পুরুষ নুশু ভাষা ও লিপিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন! ঝৌ শুয়াইয়ি নিজের এক কাকিমার কাছ থেকে এই গোপন ভাষার সমস্ত কিছু শিখেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাও সে তুং চিনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিলে সবকিছু তোলপাড় হয়ে যায়। তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতারা নুশু ভাষার যাবতীয় নিদর্শনকে সামন্ততান্ত্রিক চিনের চিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর ফল হয়েছিল ভয়াবহ। নুশু লিপিতে লেখা যাবতীয় বইপত্র ধ্বংস করে দেয় কমিউনিস্ট চিন। এমনকি এই ভাষা নিয়ে গবেষণা চালানোর কারণে ঝৌ শুয়াইয়ি’কে ২১ বছর শ্রম শিবিরে কাটাতে হয়। ২০০৩ সালে তিনি মারা যান। তার আগে নুশু ভাষায় একমাত্র অভিধানটি তিনি রচনা করে গিয়েছেন।
জ্যাংইয়াং গ্রামের কাছে অবস্থিত পুওয়েইয়ে নামে একটি ছোট্ট গ্রামে নুশু ভাষার জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই এলাকার আশেপাশের আঠারোটি গ্রামে দীর্ঘদিন যাবৎ নুশু ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। যদিও বর্তমানে এই ভাষায় আলাদা করে কেউ কথা বলে না। তবে চিন সরকার সম্প্রতি এই ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে হুনান প্রদেশের মেয়েদের মধ্যে নুশু ভাষা শেখার জন্য উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।