মানব জিনোমের বৈচিত্র্যপূর্ণ মানচিত্র

মানব জিনোমের বৈচিত্র্যপূর্ণ মানচিত্র

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ অক্টোবর, ২০২৫

মানব শরীরের প্রতিটি কোষে লুকিয়ে আছে এক বিপুল তথ্যভাণ্ডার যার নাম জিনোম। এই জিনোমই বলে দেয় আমরা কারা, কেমন দেখতে, আমাদের শরীরের ভিতর কোন রোগের প্রবণতা বেশি, এমনকি আমাদের বিবর্তনগত ইতিহাসও। সম্প্রতি মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন স্কুলল- এর নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা দল ৬৪টি সম্পূর্ণ মানব জিনোম ক্রমের বিশ্লেষণ করেছেন। এতে ধরা পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন জনজাতি ও অঞ্চলের প্রকৃত জিনগত বৈচিত্র্য। দুই দশক আগে “মানব জিনোম প্রকল্প” প্রথম মানব জিনোমের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরি করে। কিন্তু সেই রেফারেন্স জিনোম ছিল মূলত ইউরোপীয় উৎসভিত্তিক। এখানে বিশ্বের নানা জনজাতির জিনগত বৈচিত্র্য প্রতিফলিত হয়নি।

ফলে পরবর্তী বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা কেবল ছোটখাটো পরিবর্তন, একক অণুর পার্থক্য (একক নিউক্লিওটাইড পরিবর্তন) নিয়েই কাজ করেছেন। কিন্তু বড় কাঠামোগত পার্থক্য বা “গঠনগত বৈষম্য” প্রায় অনাবিষ্কৃতই রয়ে গিয়েছিল। নতুন এই গবেষণায় এক দল বিজ্ঞানী বিশ্বের ২৫টি ভিন্ন মানব জনসমষ্টি থেকে ৬৪টি আলাদা আলাদা জিনোমের ক্রম বিশ্লেষণ করেছেন। প্রতিটি জিনোম বিশ্লেষণ করা হয়েছে একেবারে স্বাধীনভাবে, পুরনো কোনো রেফারেন্স জিনোমের উপর নির্ভর না করেই।

এই পদ্ধতি পূর্ববর্তী সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দিয়েছে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে সর্বাধুনিক “দীর্ঘ-পাঠ” প্রযুক্তি। এতে একেকটি ডিএনএ টুকরো অনেক বেশি দৈর্ঘ্যে পাঠ করা সম্ভব। ফলে মানুষের জিনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত পরিবর্তন, যা পূর্বে বোঝা যেত না, তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা “চলমান উপাদান” ( মোবাইল এলিমেন্ট ) নামের ডিএনএ অংশও শনাক্ত করেছেন। এটি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে গিয়ে জিনের কার্যকারিতা বদলে দিতে পারে। এই উপাদানগুলোই অনেক সময় রোগের উৎস কিংবা বিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। গবেষণার সহ পরিচালক অধ্যাপক স্কট ডিভাইন বলেন, “এই নতুন প্রযুক্তি এমন সব অঞ্চল উন্মোচন করছে, যা আগে আমাদের কাছে অদৃশ্য ছিল। যেখানে জিনের পরিব্যক্তি, রোগপ্রবণতা এবং জিনের প্রকাশের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ লুকিয়ে থাকে।”এই নতুন তথ্যভাণ্ডার চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশাল প্রভাব ফেলবে। ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জিন গঠন বিশ্লেষণ করে এখন বোঝা যাবে কোন রোগের প্রবণতা কোন জনগোষ্ঠীতে বেশি, কিংবা কোন জিন আসলে কোনো রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা জাগায়। ই. আলবার্ট রিস একে বলেছেন, “জিন নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির প্রকৃত ভিত্তি বোঝার পথে এক বিশাল অগ্রগতি।” মানুষের জিনোম এখন শুধু একরকম মানচিত্র নয়, বরং বহু সংস্কৃতি, জনজাতি ও ইতিহাসের সমাহার, এক জীবন্ত মোজাইক। নতুন এই ৬৪টি জিনোম সেই মোজাইককে আরো স্পষ্ট, বাস্তব এবং মানবজাতির বৈচিত্র্যের উপযোগী করে তুলেছে।

 

 

সূত্র: “Haplotype-resolved diverse human genomes and integrated analysis of structural variation” by Peter Ebert, Peter A. Audano, et.el,25 February 2021, Science.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six − four =