মানুষের অন্তর্ধান- ‘দখল দরজা’য় দাঁড়িয়ে কারা !

মানুষের অন্তর্ধান- ‘দখল দরজা’য় দাঁড়িয়ে কারা !

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ জানুয়ারী, ২০২৫

মানুষ নেই। পৃথিবীর বুকে আর একটিও মানুষ নেই। ভাবা যায় ! কিন্তু এরকমটি ঘটার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। সবচেয়ে পটু প্রজাতি হিসেবে মানুষ স্থলে, জলে তার আধিপত্য কায়েম করে নিয়েছে – তবুও বিবর্তনের ইতিহাস বলছে অন্য কথা – কোন প্রজাতি চিরস্থায়ী নয়। মানুষও।

মানুষ ছাড়া পৃথিবী এবং তার পরবর্তী বিশ্ব, কার দখলে থাকবে – বিষয়টি যথেষ্ট কৌতুহল এবং চিন্তার। আমাদের উদভাবনী শক্তি আর অন্যদিকে লোলুপ রাজ-বাসনা, বন, সাগর, মহাসাগর এমনকি বায়ুমণ্ডলের চেহারা পাল্টে দিয়েছে নাটকীয়ভাবে। যদিও অনেক গবেষক মনে করেন, মানুষ না থাকলে, প্রকৃতির এই ‘হার মানা হার’ পাল্টে গিয়ে সে তার নিজের পুরনো ভঙ্গিমায় ফিরে আসবে, অনায়াসে। তাহলে, মানুষ না থাকলে, কে বা কারা আমাদের জায়গা নেবে?

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিম কুলসন জীববিজ্ঞান এবং বিবর্তন নিয়ে বহুবছর কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, আমাদের অন্তর্ধান, নতুন এক প্রজাতির জন্য আশ্চর্য্যজনকভাবে ‘দখল-দরজা’ খুলে দিতে পারে। ‘দ্যা ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি অফ আস’ বইটিতে, তার আলোচিত বিষয়বস্তুগুলির মূল বিষয়, বিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে জীবের মধ্যে কীভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে এবং তারা পরিবেশের সাথে আরও ভালোভাবে কীভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তা তিনি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, জিনের বেশিরভাগ পরিবর্তন ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও কখনো কখনো কিছু পরিবর্তন, প্রাণীদের আরো ভালোভাবে বাঁচতে এবং বংশবিস্তার করতে সুবিধাও দিয়েছে। পরিবর্তনের গতি অনেক ধীর হওয়ায়, জিনের এই সহায়ক পরিবর্তনগুলি যখন একটি প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে যায়, তখন সেগুলি আরো ‘সাধারণ বিষয়’ হয়ে ওঠে।

টিমের দৃষ্টিতে, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং জিনগত পরিবর্তন, ঝুঁকির সম্ভাবনা এড়িয়ে, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে তা উন্নতি নাকি বিলুপ্তির পথে, সেটা তখনই বোঝা যায় না। সুতরাং যে কোনো প্রজাতির কাছেই চিরস্থায়িত্বের সূত্র সেইখানেই ব্যর্থ হয়ে যায়। সুতরাং মানুষও চিরস্থায়ী নয়, মানুষের বিলুপ্তিও অনিবার্য।

“মানুষ এবং তার ঘনিষ্ঠ গ্রেট এপ, মারা গেলে কোন প্রজাতিগুলি আমাদের জায়গা নিতে পারে! ” তারা মানুষের মতনই বুদ্ধিদীপ্ত হবে কিনা কেউ জানে না। সেক্ষেত্রে, টিম প্রস্তাব দিয়েছেন, “নতুন ধরনের বুদ্ধিমত্তা এবং জটিলতা অপ্রত্যাশিত উপায়ে আবির্ভূত হতে পারে”। ভবিষ্যৎ প্রজাতি যে মানুষের মতন বা তার থেকে অন্যরকম বুদ্ধিমত্তা বা নয়া প্রযুক্তি নিয়ে আসতে পারে, সেই সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করে এই প্রস্তাব ।

কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, প্রাইমেটরাই আমাদের সম্ভাব্য উত্তরসূরী। কিন্তু এ বিষয়ে টিমের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আসলে, প্রাইমেটরা সামাজিক দিক থেকে একে অপরের প্রতি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। শিকার, প্রতিরক্ষামূলক কাজকর্ম এদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। এই ধরনের সীমাবদ্ধতা, নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে মানিয়ে নিতে এদের বেশ অসুবিধার মুখে ফেলবে।

প্রাইমেটের পরিবর্তে টিম এখানে প্রতিযোগী হিসেবে যাকে রেখেছেন, তা বেশ অবাক করার মতন। অক্টোপাস। তাঁর মনে হয়েছে, অক্টোপাসের চতুরতা এবং অভিযোজন ক্ষমতা, তাদেরকে উত্তরসূরীর শ্রেষ্ঠ দাবিদার বানাতে পারে।

“সঠিক পরিবেশ পেলে অক্টোপাস, তাদের জটিল সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, একে অপরের সাথে যোগাযোগ করার কৌশল এবং অন্যান্য বস্তুকে নিয়ে নাড়াচাড়া করার ক্ষমতা দিয়ে অনায়াসে একটি সভ্যতা তৈরি করতে পারে”। টিমের গবেষণাদলের সদস্যরা দেখে চমকে যান যে, ” গবেষণা কেন্দ্রে, রাতের বেলায় অনেকগুলি অক্টোপাস নিজের ট্যাঙ্ক থেকে পালিয়ে, প্রতিবেশী ট্যাংকগুলিতে রাখা বাকি অক্টোপাসদের সাথে দেখা করে”। এটা অবিশ্বাস্য হলেও, সত্যি। অক্টোপাস ভীষণ কৌতূহলী। কৌতূহল এ ভর করে, এরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে যথেষ্ট উদ্যোমী।

টিম মনে করেন, “খাদ্য শৃঙ্খলার শীর্ষ স্থানে , ডাঙার স্তন্যপায়ী প্রাণীরা অনেক এগিয়ে থাকলেও, মানুষ পৃথিবী থেকে সরে গেলে ভবিষ্যতের বাস্তুতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে – সমুদ্র। তবে হয়ত ভূমি জীবনে, অক্টোপাসরা খুব একটা বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না। তারা অমেরুদণ্ডী। তাই দ্রুত চলাচলের জন্য ‘জল-জীবন’ই তাদের কাছে শ্রেয়”।
“অক্টোপাস কি জলের নিচে মস্ত একটা শহর তৈরি করবে? নাকি বিবর্তনগত সুবিধার হাত ধরে, হরিণ শিকারের জন্য অন্য রকমের শ্বাসযন্ত্রের বিকাশ ঘটাবে, যার সাহায্যে তারা মাটির উপরে উঠে আসবে ! তা নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই। যেমন অতীতে কেউই বলতে পারেনি যে প্রাচীন প্রাইমেটরা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ধীরে ধীরে দ্বিপদ মানবে পরিণত হবে।

তবে অক্টোপাস কি মানুষের প্রতিস্থাপক হতে পারে অথবা প্রাইমেট্ররা ? তারাও যদি মারা যায় কখনো! যেখানে স্তন্যপায়ী প্রাণী বিশেষত যারা ভূমিতে আধিপত্য কায়েম করেছে সেই রকম এক বিশ্বে কোন একটা জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণীকে উত্তরসূরি হিসেবে কল্পনা করা দুঃসাহসিক। টিম একেবারে জোরের সাথে দাবী করতে পারেননি এটাই ঘটতে চলেছে। জিনের এলোমেলো মিউটেশন, অপ্রত্যাশিত বিলুপ্তির ঘটনা এবং জনবিস্তারের ক্ষেত্রে বিবর্তনের বাধা পুরো বিবর্তনের গতিপথকেই উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এতে করে ভবিষ্যতের অগণিত সম্ভাবনাই উন্মুক্ত রইল।

বিবর্তনের ধারা কেমন হবে, অদ্ভুতুড়ে শুনতে লাগলেও আসলে সেটা কোনদিকে এগোবে তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের এখনও তৈরি হয়নি- এমনটাই টিমের বই দাবি করছে। তবে এই মুহূর্তে এই গ্রহ যে মানুষের দখলে এবং সেটা বদলাবে না তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা করতে উৎসাহিত করেন, টিম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 5 =