মালদহ থেকে হুগলি গঙ্গার ভাঙন

মালদহ থেকে হুগলি গঙ্গার ভাঙন

শুভাংশু কুমার রায়
Posted on ১ জানুয়ারী, ২০২২

পৃথিবীতে মানুষ আসার আগেও বাংলায় এই নদী বইছিল তার আপন খেয়ালে যার নাম সাধারণ নাম গঙ্গা, বিশেষ নাম ভাগীরথী (মুর্শিদাবাদ থেকে নবদ্বীপ) ও হুগলি (নবদ্বীপ থেকে মোহনা) । এই সুপ্রাচীন ইতিহাসের পাশে সাম্প্রতিক কমবেশি এক হাজার বছরের নদীমাতৃক সভ্যতায় গঙ্গানির্ভর মানব বসতির জীবন ও জীবিকায় কৃষি, শিল্পের বিকাশ গঙ্গার সে খেয়ালের প্রকৃতি বা প্রকৃতির খেয়াল ঠিক বুঝতে পারল না । ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ের শক্ত পাথরের কোলে নাচতে নাচতে গঙ্গা এসে পড়ল রাঢ়বাংলার রুক্ষভূমিতে । পশ্চিমবঙ্গে মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ জেলায় এসে নিজেই পেতে নিল নরম পলিমাটির বিছানা । তারপর হঠাৎ সম্ভবত ভূমিঢালের বদলের জন্য এক থেকে দুই হয়ে দু’জনার দু’টি পথ দু’টি দিকে বেঁকে গিয়ে ভারত ও বাংলা, দুই রাজনৈতিক বিভাজন তথা ভাঙনের সাক্ষী হয়ে গেছে । হুগলি-ভাগীরথী দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে আর পদ্মা নদী পূর্ব দিকে বাংলাদেশে বিভাজনের পর রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয় গঙ্গার জলের অধিকার নিয়ে যার পরিণামে তৈরি হয় ফরাক্কা বাঁধ । এই ব-দ্বীপ অঞ্চলে পশ্চিমবাংলার গঙ্গায় শুরু হয় নদীর পাড় ভাঙনের গভীর এক করুণকথা । সরকারি স্তরে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮ বর্গ কিমি ভূমি বিনষ্ট হয় । সেই সঙ্গে গঙ্গামাতৃক সভ্যতায় বিপন্ন হয় গরিব প্রান্তিক নিরীহ বিশাল সংখ্যক মানুষের সভ্যতা । প্রশ্নটা হল, এর জন্য মানুষ আর প্রকৃতি, কার দায় কেমন ? কী ভাবেই বা সুরাহা মেলে ?
গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে বঙ্গোপসাগরে মেশার আগে দীর্ঘ পাথুরে খাতে উচ্চমাত্রায় ঘর্ষণ থেকে যে বিশাল পলি মাটি তৈরি করে তা বহন করে সোজা পশ্চিমবাংলায় সমতল ভূমিতে ঢোকার পর গঙ্গা তার মতি ও গতি দুইই দারুণ ভাবে বদলায় । নিজের জমানো পলি নিজের চলার পথে জমে তলদেশের গভীরতা ক্রমশঃ কমতে থাকে । মম চিত্তে নিতি নৃত্যের ছন্দ বদলায় । আঁকাবাঁকা পথের চলনে সবথেকে বড় বাধা পায় মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার প্রায় দশ কিলোমিটার চওড়া ব্যারেজ থেকে । পরে অতিরিক্ত জল ধারণের জন্য একটা বড় নদী বাঁক তৈরি হয় । গঙ্গার তলদেশে হঠাৎ করে প্রচুর পলি জমা হয় । জলস্রোতের বিশেষ ঘুর্ণনে বাঁ নদীতীরের ব্যাপক ভাঙন ও ক্ষয় শুরু হয় ।
আলোচ্য গঙ্গাভাঙনের মাত্রা বেড়েছে ফরাক্কা বাঁধ নির্মাণ থেকে । এটা মানুষের তৈরি । অতীতে গঙ্গা রাজমহল থেকে আনুমানিক ৪০ কিলোমিটার ভাটিতে বইত গৌড়এলাকা দিয়ে যে গৌড় গঙ্গার কাছে হওয়ার কারণে হয়েছিল বাংলার রাজধানী । আবার গঙ্গা দূরে সরে গিয়ে গৌর গুরুত্ব হারাল । ধীরে ধীরে গঙ্গা পশ্চিম দিকে সরে গেছে যে অঞ্চল হয়েছে নরম ও ভঙ্গুর । প্রশ্ন আসে, মানুষকি ভুল করেছে ? অথবা সভ্যতার পথে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথডে নেগেশন অফ নেগেশন বা নেতি নেতি করে চলেছে এভাবে ? হয়তো রাজধানী কলকাতা বাঁচাতে ফরাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ এক রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক সিদ্ধান্ত । সে বিতর্ক পাশে রেখে পরিণাম দেখা যাক ।
এই ভাঙনে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় বেশ কিছু উর্বর জমি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে । ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বাধ্য হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে জীবন ও জীবিকার নতুন ঠিকানা নিয়ে চলে গেছে । কাজের সন্ধানে পশ্চিমভারতে গুজরাট, মহারাষ্ট্রে বা দক্ষিণ ভারতে চলে যায় পরিযায়ী শরণার্থী শ্রমিক হিসেবে । মালদহে মনিকচক, কালিয়াচাক ১, ২, ৩, রতুয়া ১,২, পঞ্চানন্দপুর, গোপালপুর, ধরমপুর, হরিণানন্দপুর, কাঁকড়াবন্ধা, ঝাউবোনা, বাঙ্গিতলা ইত্যাদি জায়গার কিছু অংশ হয় গঙ্গায় তলিয়ে গেছে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । মুর্শিদাবাদে ফারাক্কা, সমসেরগঞ্জ, সুতি ১, ২, রঘুনাথগঞ্জ ২, লালগোলা, ভগবানগোলা ১, ২, রাণীনগর ১, ২, জলঙ্গী ইত্যাদির ক্ষেত্রে এক কথা প্রযোজ্য । রঘুনাথগঞ্জ থেকে জিয়াগঞ্জ এবং দাইঁহাট থেকে বলাগড় গঙ্গায় বিশেষ বাঁক ও নানা চর তৈরি হয়েছে ।
নদিয়া জেলার কালীগঞ্জ থেকে কল্যাণী ক্ষতিগ্রস্ত । শান্তিপুর ভাঙনে প্রচুর চাষের জমি গঙ্গায় তলিয়ে গেছে । নবদ্বীপ ও বলাগড়ে এসে ভৌগোলিক কারণে গঙ্গার মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা । অজস্র চর হয়ে বিচিত্র আলপনা তৈরি করছে । এই সব জায়গার নদী-বন্দর, বাণিজ্য কেন্দ্র, সরকারি দপ্তর, স্কুল, মিল, চিনিকল, বাজার হারিয়ে গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । প্রায় সত্তর বছর হল এই ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে । সবুজ দ্বীপ এক পর্যটন কেন্দ্র হয়ে গেছে । খয়রামারি ইত্যাদি চর ভাঙনে তলিয়ে গেছে । বাঁশবেড়িয়া থেকে বালি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ গঙ্গার তীর পলিমাটিযুক্ত যা ভাঙনপ্রবণ হয়ে গেছে । ইতিমধ্যে চন্দননগর থেকে উত্তরপাড়ার বিরাট অংশ জুড়ে গঙ্গার পাড় ভাঙছে ।
এই ভাঙন হয় দু’ভাবে । বন্যার আগে পাড়ের দেওয়ালে জলচাপ বেড়ে ধাক্কা দিয়ে ভাঙে । ক্রমশঃ গঙ্গা চওড়ায় বাড়ে । বন্যা হয় । আর বন্যার পরে বন্যার জলে পাড় দুর্বল হলে ভাঙে । পাহাড়ি পাথুরে শক্ত নদী থেকে সমতলের নরম পলিতে পড়ে সৃষ্ট ভাঙন হয়তো রোখা যেত না, হয়তো অনেক দেরিতে ভাঙন হত অন্যভাবে, হয়তো এত মানুষ বিপন্ন হতেন না যদি ফরাক্কা ব্যারেজ না হত । আবার ফরাক্কা ব্যারেজ হওয়ার অনেক সুবিধে হয়েছে । রাষ্ট্র কস্ট বেনেফিট ও ড্যামেজ বিশ্লেষণ করে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা করলে তা বোঝার সুবিধা হবে । এই সঙ্গে দেখা যাক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ।
এক, কোনো অন্য চ্যানেল করে বাঁ তীরে স্রোতের ধাক্কা কমাতে হবে । দুই, কোনো ভাবে পূর্ব দিকে যথাক্রমে কালিন্দ্রী, মহানন্দা, পদ্মায় মিশে যাবে । তখন গঙ্গার স্রোতজনিত ভাঙন কমবে । কিন্তু পশ্চিমবাংলা তথা ভারতের গঙ্গায় জল কমে গিয়ে রাজনৈতিক ভাবে ফের বিতর্ক তৈরি করবে । তিন, নিয়মিত ড্রেজিং করে নাব্যতা বাড়াতে হবে । চার, ভ্যাটিভার ঘাস, জিও ম্যাট দিয়ে পাড় শক্ত করতে হবে । এসব আপাত সমাধান মাত্র । গঙ্গায় জোয়ার-ভাটা খেলে, সুতরাং বিধি অনুযায়ী পাড় থেকে ৪৭ মিটারের মধ্যে কোনও নির্মাণ করা যায় না । কিন্তু হুগলি জেলায় অনেক পুর এলাকাতে বিধির বাইরে এমন নির্মাণ হয়েছে । ঐ সব অঞ্চলে বহুতল আবাসন গড়ে উঠেছে যার ভিত ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে । এটুকু বলা যায়, ভাঙন আপাতত ঠেকাতে সেচ দফতর, পোর্ট ট্রাস্ট, পুরসভা সবাই মিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে ক্ষতি কমবে ।
১৯৫৫, ১৯৭৭, ১৯৯০, ২০০১, ২০০৩, ২০০৫ সময়ে স্যাটেলাইট ইমেজ অনুযায়ী নদীতীরের ভূমিস্তরের পরিবর্তন, রাজমহলের কাছে পাথরের উপস্থিতি, প্রচুর পলিমাটির থিতান, এই পলি ড্রেজিং-এ সমস্যা ও ফরাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ থেকে গঙ্গার স্বাভাবিক গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে । আর তা থেকেই নদীর বাঁকের এত বিচ্যুতি, নদীতলে পলির নানা স্তর পড়া ইত্যাদির সৃষ্টি । (সূত্র গবেষণাপত্র River bank erosion hazard study of river Ganga, upstream of Farakka barrage using remote sensing and GIS, Praveen K.Thakur, Chalantika Laha, S.P. Aggarwal) সাধারণভাবে গঙ্গা উৎফুল্ল কিশোরী, পরিণত বয়স্কা নয়, এখানে থুত্থুরে বৃদ্ধা । এই বৃদ্ধা প্লাবনের পলিজাত ফসলের উপকারিতা দিচ্ছে কিন্তু সেই পলিজমে বন্যা ও ভাঙন আমাদের অস্তিত্ব দুর্বল করে দিচ্ছে ।
আনুমানিক সাত দশক ধরে এই ভাঙনের তীব্রতা বলা যায় সাম্প্রতিক । সাম্প্রতিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যুদ্ধ থেকে নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও ভৌগোলিক ক্ষেত্রে গঙ্গার গতিপথ নিয়ে তেমন নজর দেয় নি । অথচ সুযোগ ছিল । কিছু গবেষণা নিশ্চয় হয়েছে যে গুলির প্রয়োগ হয়নি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় । কলকাতা মেট্রো বর্ষার জলে ডুবলে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় প্রচারমাধ্যম ফেটে পড়ে । নতুন পরিকল্পনা হয় । অথচ গঙ্গার ভাঙনে জমিহারা বাড়িহারা জীবিকাহারা বাংলার মানুষের জীবনযন্ত্রণা উপেক্ষিত থেকে যায় । কলকাতা বন্দর বাঁচানোর ক্ষেত্রে ফরাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে জলের যোগানের কথা গুরুত্ব পেলেও নিয়মিত ও যথাযথ ড্রেজিং-এর অভাব গুরুতর সমস্যা তৈরি করে যার ফলে গঙ্গার উপরের অংশ ভাঙনের প্রভাব বেড়ে চলেছে । এখন ফরাক্কা নামক শ্যাম রাখি না গঙ্গাতীরের মানুষের আর্থসামাজিক কূল রাখি – এক ভীষণ সঙ্কট । চটজলদি সমাধান নেই । জায়গা বিশেষ নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে ভাবতে হবে । হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষা থেকে সতর্ক হয়ে বিপদ বুঝে দূরে যেতে হবে । দেখা যাচ্ছে নদীকে বেঁধে তাকে দায়ী করা কাজের কথা নয় । নদীমাতৃক মানুষের দায় নদীকে নিয়ে নিজেদের বাঁচানো ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × four =