মৃত মানুষের মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি পুনরুদ্ধার সম্ভব?

মৃত মানুষের মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি পুনরুদ্ধার সম্ভব?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ জানুয়ারী, ২০২৫

স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কে স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট ভৌত স্থানগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন। প্রিয় মানুষ মারা গেলে, তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র থেকে যায়, কিন্তু তার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা – তার কী হয়? সেই মৃত ব্যক্তির মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি পুনরুদ্ধার করা কি সম্ভব? সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী ডন আর্নল্ড বলেন, স্মৃতির কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হলেও হতে পারে, তবে তা প্রযুক্তিগতভাবে খুব চ্যালেঞ্জিং। তিনি জানান এর জন্য মস্তিষ্কের কোশে নির্দিষ্ট স্মৃতি এনকোড করার নিউরনের সেট শনাক্ত করতে হবে। তার থেকে বুঝতে হবে নিউরনগুলো কীভাবে সংযুক্ত। তারপর, সেই নিউরনগুলো সক্রিয় করে, মস্তিষ্কের কাজ করার পদ্ধতি অনুকরণে আনুমানিক এক নিউরাল নেটওয়ার্ক, মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম তৈরি করতে হবে। আর্নল্ড জানান, নানা নিউরনের গুচ্ছ বিভিন্ন স্মৃতি এনকোড করে। হিপ্পোক্যাম্পাসে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি তৈরি হয়। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের বক্তব্য অনুযায়ী, মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশে স্মৃতির বিভিন্ন দিক যেমন আবেগ, নানা সংবেদনশীলতা সংরক্ষিত হয়।
আর্নল্ড জানান, একক স্মৃতির সাথে যুক্ত নিউরনের গুচ্ছ মস্তিষ্কে একটা ছাপ রেখে যায়, সেই ছাপকে এনগ্রাম বলা হয়। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসে এনগ্রাম শনাক্ত করেছেন। যেমন ২০১২ সালে নেচার জার্নালে গবেষকরা ভয়ের জন্ম দেয় এমন অভিজ্ঞতার স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোশগুলো খুঁজে পেয়েছেন। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের মতে, মানুষের স্মৃতি জটিল, বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি, এটা কোনো অবস্থান, সম্পর্ক বা দক্ষতার সাথে যুক্ত থাকতে পারে। মৃত ব্যক্তির স্মৃতি পুনরুদ্ধার করা আরও জটিল, কারণ স্মৃতির বিভিন্ন অংশ মস্তিষ্ক জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। যেমন সংবেদনশীলতা প্যারিয়েটাল লোব ও সেনসারি কর্টেক্সে সংরক্ষিত থাকে।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন অনুসারে, একটা নির্দিষ্ট এনগ্রামের মধ্যে নিউরনগুলো সাইন্যাপসের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে, এই স্থানে ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল সংকেতগুলো ঘুরে বেড়ায়। যখন কোনো স্মৃতিচারণা করা হয়, তখন এই নিউরন গুচ্ছগুলোর সাইন্যাপসের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হতে থাকে। এই যোগসূত্রের শৃঙ্খল মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে যেখানে সাইন্যাপস রয়েছে, সেখানে হতে পারে। মূল ঘটনার সময় সক্রিয় নিউরনগুলো এনগ্রাম তৈরি করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, মস্তিষ্কে একত্রিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিগুলো বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। এনগ্রাম আসলে স্মৃতি নয় এখানে স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে। তাই এনগ্রাম খুঁজে পেলেও মৃত ব্যক্তির অভিজ্ঞতা অনুসারে মূল ঘটনা পুনরায় তৈরি করা কঠিন।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেমোরি অ্যান্ড প্লাস্টিসিটি প্রোগ্রামের ডিরেক্টর চরণ রঙ্গনাথ জানান, স্মৃতি হল পুনর্গঠনমূলক। অর্থাৎ আমরা একটা ঘটনার টুকরো অংশ মনে রাখি, কিন্তু পুরোটা মনে থাকে না। এটা স্মৃতি গঠনের এক সাশ্রয়ী উপায়, কারণ মস্তিষ্ক বাকি শূন্যস্থান পূরণ করে নেয়। মস্তিষ্ক ইতিমধ্যেই যা জানে তা ব্যবহার করে, অভিজ্ঞতার প্রতি অংশ নতুনভাবে রেকর্ড করতে হয় না। কেউ হয়তো তার পাঁচ বছরের জন্মদিনের পার্টিতে চকলেট কেক খাওয়া আর গান বাজনার কথা মনে রেখেছে, কিন্তু তার অন্যান্য বিবরণ কোন বন্ধুরা উপস্থিত ছিল, বৃষ্টি হচ্ছিল কিনা এসব মনে নেই। তার কাছে সেই অভিজ্ঞতার সামগ্রিক স্মৃতি রয়েছে। রঙ্গনাথ বলেন, নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলের জন্য ব্যক্তির জীবনকাল ধরে মস্তিষ্কের স্ক্যানের প্রয়োজন হবে। তারপর, কারোর মৃত্যুর পরে নির্দিষ্ট স্মৃতি পুনরায় তৈরি করতে নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা যায়। কিন্তু স্মৃতি স্থির নয়, স্মৃতি গতিশীল। আমরা আমাদের স্মৃতিগুলো এমনভাবে সব ধরণের অর্থ এবং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সাজাই যা মূল ঘটনার প্রতিফলন নয়। আমরা অতীতে আবার ফিরে যাই না, আমরা কেবল কল্পনা করি যে অতীত কেমন হতে পারত। রঙ্গনাথ বলেন, এতে আমরা অতীত অভিজ্ঞতাগুলো কেবল এক সাধারণ ঘটনার সিরিজ হিসাবে বোঝার চেষ্টা করি। তার মতে বর্তমানে, জীবনের স্মৃতি ব্যক্তির মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × three =