মৌমাছি কেন কামড়ায়?

মৌমাছি কেন কামড়ায়?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ এপ্রিল, ২০২৫

মৌমাছিদের কামড়ের অন্তর্নিহিত কারণ বা উদ্দেশ্য খুঁজছেন কনস্টাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গবেষক কবিতা কান্নান এবং স্নায়ুবিজ্ঞানী মুরগান নুভিয়ান। দেখা গেছে, কিছু মৌমাছি একেবারে শুরু থেকেই দংশনে অপটু। মৌচাক একই ছন্দের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হলেও, কিছু কিছু মৌমাছির ব্যক্তিত্ব আলাদা। চাকে ঢিল মারলে, কোন মৌমাছি কামড়াবে – সেই সিদ্ধান্ত নিতান্তই তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের উপরে নির্ভর করে। এই গবেষণার জন্য ‘রক্ষী মৌমাছি’দের বেছে নেওয়া হয়েছিল। এরা একেবারে সামনের সারির। মৌমাছিদের একটি ঘুরন্ত নকল শিকারির কাছাকাছি আনা হয়। মৌমাছিগুলির কোনো ক্ষতি না করেই তাদের উপরে পরীক্ষা চালানো হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় কামড় দেওয়ার পরেই মৌমাছির মৃত্যু হয়। মৌমাছিগুলির ক্ষেত্রে কামড় একটি বিশেষ অস্ত্রের থেকেও আরো অনেক বেশি অর্থ বহন করে। কামড় বসানো সময় তারা এক জটিল ঘ্রাণ সংকেত ছাড়ে যা স্ট্রিং এলার্ম ফেরোমন নামে পরিচিত। এর দ্বারা তারা অন্য মৌমাছিগুলোকে সতর্ক করে এবং তাদের দলবদ্ধভাবে সচেতন করতে বা আক্রমণ হানতে আহ্বান জানায়। যত বেশি মৌমাছি এই সংকেতে সাড়া দেয় ততই ঘ্রাণ সংকেতের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় । তারা এমন এক কৌশল তৈরি করে যাতে খুব বেশি হতাহত না হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ঘ্রাণ সংকেত সব মৌমাছির উপর সমান প্রভাব ফেলে না। এই সংকেতের উপস্থিতি হুল ফোটানোর সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু কিছু মৌমাছি আবার পিছিয়েও যায়। যে সমস্ত মৌমাছিরা পরীক্ষায় একবার হুল ফোটাতে চেয়েছিল তারা প্রায়শই হুল ফোটানোর জন্যই এগিয়ে আসতে থাকে। অন্যরা বিপদের কথা জেনেও নিষ্ক্রিয় থেকে যায়। গবেষকরা চারবার পরীক্ষাটি চালিয়ে মৌমাছিদের এই প্রতিক্রিয়া নথিভুক্ত করেন গবেষকরা। ফলাফলগুলি আশ্চর্যজনক ছিল। বেশিরভাগ মৌমাছির মধ্যে হুল ফোটানোর এই আচরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। কেউ কেউ প্রতিবারই হুল ফোটায়, অন্যরা কখনো হুল ফোটায় না, আবার কেউ কেউ একটি দুটি বিকল্পের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় থাকে। এই সিদ্ধান্তগুলি তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, যেমন স্নায়বিক বা হরমোন জনিত কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। মৌমাছিরা কেবল উদ্দীপকের উপর ভিত্তি করে তাদের সিদ্ধান্তর মূল্যায়ন করে না বরং এই মূল্যায়ন তাদের মেজাজের উপরেও নির্ভর করে। সামাজিকতার দিক থেকে মৌমাছিরা এগিয়ে রয়েছে। একটি মৌমাছির উপস্থিতি আশ্চর্যজনকভাবে পুরো দলটির উপর প্রভাব ফেলতে পারে। আক্রমণাত্মক মেজাজকে উৎসাহিত করার পরিবর্তে তাকে দমিয়েও দিতে পারে। একই হুমকির মুখোমুখি হলেও একক মৌমাছির তুলনায় জোড়া মৌমাছির দংশনের সম্ভাবনা কম লক্ষ্য করা যায়। বৃহৎ গোষ্ঠী মানে এই নয় যে প্রতিটি মৌমাছির আগ্রাসন বেশি হবে।
এ গবেষণা আগেকার ধ্যানধারণাগুলিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বৃহদাকার মৌচাক বা বৃহত্তর মৌমাছি বসতিগুলিতে মাথাপিছু প্রতিরক্ষা কমও দেখা যেতে পারে। ঘ্রাণ সংকেতে যখন একটি মৌমাছি প্রাকৃতিকভাবে সরে আসে তখন অন্য একটি মৌমাছিকে নিয়োগ করতে পারে। মৌমাছির হুল, তার পরবর্তী অংশীদারের অনুসরণ করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু একাধিক হুমকির মুখে পড়লে সেই নিয়োগ ম্লান হয়ে যায়। ঘ্রাণ সংকেতের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া হ্রাস পায়। এমনকি সামাজিক সংকেতগুলিরও মেয়াদ শেষ হতে থাকে। গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেন, আক্রমণাত্মক সমবয়সীদের মধ্যে থাকলে আক্রমণ-বিমুখ মৌমাছিরা কি সাহসী হয়ে ওঠে? সেক্ষেত্রে দেখা যায় তারা শ্রেণীবদ্ধভাবে দলের মধ্যে থাকলেও তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি স্বতন্ত্র থাকে। রঙ্গভূমিতে ঘ্রাণ সংকেতের স্তর আক্রমণাত্মক মৌমাছিদের দংশনের সম্ভাবনা বাড়ায়। তাই এক্ষেত্রে বলা যায় সমবয়সীদের চাপে পড়ে নয় বরং রাসায়নিক সংকেতের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতেই স্বভাবগতভাবে তারা হূল ফোটায় বা তেড়ে আসে। গবেষণাটি মৌচাকের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা পালনের ধারণাকে ভেঙে দেয়। প্রতিটি মৌমাছির আভ্যন্তরীণ সীমানা রয়েছে। এই সীমানাকে সংকেত প্রেরণ দ্বারা ধাক্কা দেওয়া যেতে পারে বা সময়ের সাথে নির্দেশ করা যেতে পারে। বিপদের অনুভূতি দ্বারা এটা কমানো যেতে পারে বা অন্যদের উপস্থিতি দ্বারা বাড়ানো যেতে পারে। দংশনের সিদ্ধান্ত মৌচাকের নয়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি একক মৌমাছির উপরেই নির্ভর করে।
গবেষণাটি মৌমাছির ব্যক্তিত্বের জৈবিক শিকড় অনুসন্ধানের দ্বার উন্মুক্ত করে। স্নায়ুজীববিদ্যার পিছনে হরমোনের প্ররোচনাগুলিকে খতিয়ে দেখতে আহ্বান জানায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − 4 =