মৌ রাজ্যে রানি বদল

মৌ রাজ্যে রানি বদল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৪ নভেম্বর, ২০২৫

মৌমাছির রাজ্যে হঠাৎ শুরু হয় রানিদ্রোহ। যে রানি একসময় হাজারো কর্মীর আনুগত্যের প্রতীক ছিল, একদিন দেখা যায় তাকেই ঘেরাও করে তাড়িয়ে দিচ্ছে প্রজারা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই রানি উৎখাতের পেছনে রয়েছে এক ভাইরাস। ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখিয়েছেন, ভাইরাস সংক্রমণে রানি মৌমাছির ডিম পাড়ার ক্ষমতা ও ফেরোমোন উৎপাদন দ্রুত কমে যায়। এই ফেরোমোন-ই মৌ-বসতির সামাজিক বন্ধনের মূল। এর গন্ধেই কর্মী মৌমাছিরা বুঝে নেয় রানি এখনও সুস্থ ও যোগ্য কিনা। সংক্রমণের ফলে এই রাসায়নিক সংকেত দুর্বল হয়ে পড়লে কর্মীরা বার্তা পায়, “আমাদের রানি অকেজো।“ তারপরই শুরু হয় অভ্যুত্থান। পুরোনো রানির বদলে গড়ে তোলা হয় নতুন রাজকন্যাকে। তাকে রাজকীয় জেলি খাইয়ে বড় করা হয় ভবিষ্যতের রানি হিসেবে। গবেষক ড. অ্যালিসন ম্যাকাফ্রি বলেন, “আগে ভাবতাম রানি উৎখাত হয় বয়সজনিত কারণে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর সূত্রপাত ভাইরাস সংক্রমণে।“ এ একধরনের স্বরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া, যেখানে মৌ-বসতি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নেতৃত্ব বদলে নেয়। রানির দেহে ভাইরাস ঢুকলে তার ডিম্বকোষ সঙ্কুচিত হয়ে যায়, ডিম উৎপাদন বন্ধ হয়, আর ফেরোমোন নিঃসরণও কমে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, সংক্রমিত রানির দেহে ফেরোমোন ঘাটতি ৪০% পর্যন্তও নেমে যেতে পারে। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই কর্মীরা নতুন রানি তৈরি করতে শুরু করে। এই পরিবর্তনের প্রভাব সীমাবদ্ধ নয় কেবল মৌচাকের ভেতরে। বিশ্বের প্রায় ৭৫% খাদ্যশস্য মৌমাছির পরাগায়নের ওপর নির্ভরশীল। রানি পরিবর্তনের সময় মৌ-বসতির কাজ থেমে থাকে। ডিম পাড়া বন্ধ হয়, কর্মী কমে, মধু উৎপাদন কমে যায়। এতে কৃষিক্ষেত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, ভাইরাস সংক্রমণ বাড়লে এই নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রবণতা ঘন ঘন ঘটবে, যা পরাগায়ন ব্যবস্থাকে বিপদের মুখে ফেলবে। গবেষকরা সংক্রমিত রানির দেহে কৃত্রিমভাবে মিথাইল ওলিয়েট প্রয়োগ করে দেখেছেন, উৎখাতের হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। পাশাপাশি ভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম বাহক ভ্যারোয়া ডেস্ট্রাক্টর নামের এক পরজীবী মাইট । একে নিয়ন্ত্রণ করলেই রানি সংক্রমণ কমানো সম্ভব।

গবেষণাটি মৌমাছির সমাজব্যবস্থার গভীরতাকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে। রানি কেবল শাসক নয়, সে এক রাসায়নিক সংকেত প্রেরণ কেন্দ্র। তার গন্ধেই স্থিতিশীল থাকে বসতি। আর যখন সেই গন্ধ বদলে যায়, সমাজ বদলায়, বদলে যায় নেতৃত্ব। প্রকৃতির এই বুদ্ধিমত্তা যেন এক জীবন্ত শিক্ষা। টিকে থাকার জন্য কখনও কখনও পুরনো নেতৃত্বকে সরিয়ে দিতে হয়। ভাইরাস সংক্রমণ যেন প্রকৃতির নিজের তৈরি নেতৃত্ব বদলের নিঃশব্দ ইঙ্গিত।

 

সূত্র : Viral infections at the heart of why honey bees overthrow their queen By Linda Stewart; 28 October 2025.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − twelve =