ম্যানগ্রোভ ও সুন্দরবনের কথা /১

ম্যানগ্রোভ ও সুন্দরবনের কথা /১

রথিন মণ্ডল
Posted on ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গাছেই অঙ্কুরিত হয় বীজ

(এ এক আজব জগৎ। ঘন জঙ্গল। তার মধ্যে থাকে রয়াল বেঙ্গল টাইগার। নদীতে কুমীর, কামট। দেশীয় ভাষায় বলে বাদাবন।
সেই বাদাবনের ছবিটাই তুলে এনেছেন কৃষিবিজ্ঞানী রথীন মণ্ডল। আজ প্রথম পর্ব)

ফল গাছে থাকতে থাকতে বীজ অঙ্কুরিত হয়। লাঠির মতো অঙ্কুরিত বীজগুলো গাছে ঝুলতে থাকে। ওদেরকে জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম বীজ বলে। গাছের মূল মাটি ভেদ করে উপরে ওঠে। উপরেই বাড়তে থাকে। ওরা খোলা আকাশের নিচে শ্বাস নেয়। শ্বাস নিয়ে গাছকে বাঁচায়। ওদেরকে শ্বাসমূল বলে। মোহনার ঢেউ ওদেরকে ধুয়ে দেয়। গাছগুলি সারাদিনে দুবার স্নান করে; অর্থাৎ দিন ও রাত্রি মিলে, দু-বার। নোনা জলে গাছগুলি জন্মায় ও বাঁচে। এরকম প্রায় অপরিচিত কিছু গাছের কথা ও তাদের বাসস্থান নিয়ে আলোচনা করব। এ রকম গাছের কথা কম শোনা যায়। অনেকে আবার আগে কখনও শোনেননি। শুনলেও আমাদের পরিবেশে তাদের দেখা মেলে না।
এমনিতে গাছের মূল তো থাকে মাটির নিচে। আর কাণ্ড মাটির উপরে। এভাবে গাছেরা মাটির উপরে বড় হয়। আমরা তো তাই জানি। সব গাছ আমাদের উপকার করে। মোহনার এই গাছগুলো আরও বেশি উপকার করে। এরকম গাছগুলো শুধু নিজেরাই বাঁচে না, আমাদের রক্ষা করার জন্যই যেন ওদের বাঁচতে হয়। এরাই ম্যানগ্রোভ গাছ। এরা সুন্দরবনে থাকে।

সুন্দর ও বন – এই দুটি শব্দের মিলনে সুন্দরবন। প্রকৃতির সৃষ্টি সুন্দরবন। এ এক বিশাল অরণ্য। আমাদের কাছাকাছি এই অরণ্য পৃথিবীর সেরা। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা – এই তিনটি নদীর সংযুক্ত মোহনায় সুন্দরবনের সৃষ্টি। বিচিত্র ম্যানগ্রোভ গাছের আবাস। এরা শুধুমাত্র এই পরিবেশে জন্মায়। এখানে থাকে সুন্দরী গাছ। অনেকে বলেন সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নাম। কেউ কেউ আবার বলেন সুন্দরবনের সৌন্দর্য অতি মনোরম। তাই সুন্দরবন। আবার অনেকে শুনেছে সমুদ্রের মধ্যে বন, সমুদ্রবন। সমুদ্র অপভ্রংশ হয়ে সমুন্দর পরে সুন্দর। এখন সুন্দর-বন। এর সীমানা সুদূরে বিস্তৃত। এই বনের পশ্চিমে হুগলী নদী, পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্বে বালেশ্বর নদী, বাংলাদেশ এর ঠিকানা। ভারতের স্বাধীনতার পরে এর শাসনভার দুটো দেশে চলে গেছে, কিন্তু ভৌগোলিক সীমানাটা এক। এখনও ‘দোয়েল কোয়েল পাখির ডাকে একই মূর্ছনা’।
সুন্দরী, গরান, গড়িয়া, গর্জন, গেঁয়ো, কাঁকড়া, কেওড়া, বাইন, পশুর, ধুতল, হেঁতাল আরও অনেক গাছের বনভুমি এই সুন্দরবন। ফাগুনের শেষে প্রায় সব গাছে মুকুল আসে। বসন্তের শেষে ফুল ফোটে। তখন ‘গুঞ্জরিয়া আসে অলি কুঞ্জে কুঞ্জে ধেয়ে। তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে, ফুলের মধু খেয়ে’। কবির এই কাব্যিক দৃশ্য একমাত্র সুন্দরবনে দেখা যায়। ঘুমের পর তারা জাগে। ফুলে ফুলে পরাগ সংযোগ ঘটায়। ফল ধরে, বীজ হয়। বীজ অঙ্কুরিত হয়। চারা গাছের জন্ম দেয়। চারা গাছ বড় হয়। বনরাজির প্রসার ঘটে।
খলসি – এক অতি পরিচিত ম্যানগ্রোভ গাছ। ছোট গাছ, বেশ শক্তপোক্ত। সহজে ভেঙ্গে যায় না। ফাগুনের প্রথমে ফুল ফোটায়। জানিয়ে দেয় ‘বসন্ত এসে গেছে’। থোকা থোকা ফুলে গাছ ভরে যায়। ফুলের সুরভি ছড়িয়ে পড়ে অনেক দুর। মৌমাছিরা প্রথমে আসে। পিঁপড়ে, ভ্রমর, আরও কতরকম কীট পতঙ্গ সারি দেয়। ফুলের মধু খায়। খলসির মধুর গন্ধ মোহময়। স্বাদ অপরূপ! দেখতে ঘিয়ে রং এর হয়। দাম বেশি, চাহিদা বেশি।
সুন্দরবনের মানুষের পছন্দের মধু। মউলিরা – যারা মধু সংগ্রহ করে – দল বেঁধে বনের ভেতরে ঢোকে। বনে যায় মধু সংগ্রহ করতে। খলসির ফুলে তাদের মনেও আনন্দ আসে। এবার তারা বনে যাবে, মধু আনবে। মধু বিক্রি করে সারা বছরের সংসার চলবে। ছেলেমেয়ের মুখে হাসি ফোটাবে। এ চিরন্তন এক আশা। ভাগ্য সবসময় ভরসা দেয় না। অনেকে বনের গভীরে যায়। আর ফেরে না। সুন্দরবনের রাজা, রয়াল বেঙ্গল টাইগার তাদের অনেককে ফিরতে দেয় না। এ এক পরিচিত কাহিনী সুন্দরবনের মানুষের ঘরে ঘরে। তবুও তারা প্রতি বছর বনে যায় মধুর জন্য। সুন্দরবনের গ্রামে গেলে জানা যায় অনেক স্ত্রী বিধবা হয়েছেন। অনেক সন্তানের বাবাদেরকে বাঘে মেরেছে। অনেক মা তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন। তবুও বসন্ত আসে, খলসি ফুল ফোটায়। ‘সেই বার্তা’ রটে যায় গ্রামে গ্রামে, মউলিরা যাবে বনে মধুর টানে। মা ছেলেকে বনে পাঠায়, স্ত্রী স্বামীকে, আরও অনেকে যায়, দল বেঁধে যায়, মধুর টানে বনে যায়। বিকেল বেলায় কেউ ফেরে, কেউ বা হারিয়ে যায়। ‘উদার আকাশে মুক্ত বাতাসে চিরদিন এ কি খেলা’। (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 − one =