হারিয়ে যাচ্ছে নদী, ম্যানগ্রোভও
‘ইচ্ছা করে, পরাণ টারে, যেন গামছা দিয়া বাঁধি’।।
তোর সঙ্গে মোর পীরিতি, যেন পানি আর কলসি।।
রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’। এই গঙ্গার মোহনায় পৃথিবীর বিশাল বাদাবন। এই বাদাবনের উচু গাছের কথা ও এদের অন্য প্রজাতির কথা আলোচনা করব। সুন্দরবনের নদীর মোহনায় মিঠা জলের পরিমাণ বেশি থাকলে, বড় বড় গাছগুলো নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে জলের দিকে হেলে থাকে। এদের উঁচু মাথা দূর থেকে দেখা যায়। এরাই সুন্দরবনের সবচেয়ে উঁচু গাছ। টক কেওড়া। মাঝিরা নৌকোর নোঙ্গরের দড়ি এদের গুঁড়িতে বেঁধে রাখে ভাটার সময়। অথবা জোয়ারে। নৌকার দেহটা কেওড়া গাছে বাঁধা থাকে। পরানের খোঁজ, পীরিতির কথা জানা নেই।
কেওড়া – সুন্দরবনের জলের লবণের মাত্রা বাড়তে থাকায় এরা কোণঠাসা। তাই এদের সংখ্যা সুন্দরবনে ক্রমশঃ কমছে। এরা বাদাবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। এদের তিন রকমের প্রজাতি সুন্দরবনে পাওয়া যায়। চাক কেওড়া, টক কেওড়া, আর ওড়া। ভুলবশত লোকে ওড়াকেও চাক কেওড়া বলে। এই সমস্ত প্রজাতির গাছে শ্বাসমূল হয়। বড়ো বড়ো শ্বাসমূল। রডের মতো লম্বা লম্বা, আর উঁচু। মাথাটা সরু ফলার মতো। গাছের চারদিক ঘিরে বেড়ে ওঠে। মনে হবে অনেকগুলো ফলা মাটিতে যেন কেউ গেঁথে রেখেছে। এদের শ্বাসমূলে পেয়ারা গাছের মতো ছাল ওঠে। ছাল উঠলে এদের গায়ে সবুজ অংশ দেখা যায়। শ্বাসক্রিয়া ছাড়াও এরা সালোক সংশ্লেষ করে। প্রায় সমস্ত শ্বাসমূল কমবেশি সালোক সংশ্লেষ করতে পারে।
সুন্দরবনে কেওড়ার তিনটি প্রজাতির অস্তিত্ব প্রায় সংকটে। চাক কেওড়া কম নোনা জলে জন্মায়, এদের কিছু সংখ্যা এখনও বিদ্যাধরী নদীর ধারে ধারে দেখা যায়। নদীর ময়লা বর্জ্য জলের মধ্যেও এরা আপ্রাণ বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই। লাগামহীন মাছের ভেড়ি ও ইটের ভাটার আগ্রাসনে এদের বাসস্থানের অস্তিত্ব আজ সংকটে। উত্তম-শর্মিলা অভিনীত ‘আনন্দ আশ্রম’-এর লাল টুকটুকে কৃষ্ণচুড়া গাছ, ঘুসিঘাটা, এখানেই সুন্দরবনের কিছু চাক কেওড়া এখনও বেঁচে আছে। এদের ফল চ্যপটা, এদের চারাগাছ প্রায় দেখা যায় না। এরা নিশ্চিত মৃত্যুর দিন গুনছে। ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’, আর কতদিন বেঁচে থাকবে এরা জানে না।
কেওড়াতলা মহাশ্মশান, ঠিকানা কালীঘাট, কলকাতা। অনুমান করা যায়, এক সময় এখানে কেওড়া গাছের আধিক্য ছিল। স্থানের পরিচিতির জন্য নাম কেওড়াতলা। কালের স্রোতে কেওড়ার অপমৃত্যু হয়েছে। তার জায়গায় কলকাতা নগরীর মহাশ্মশান। গাছের ধ্বংস হলে মানব সভ্যতাও লোপ পায়। এ এক অশনি সংকেত। এখনও কেওড়ার চারাগাছ কলকাতার গঙ্গার পাড়ে দেখা যায়। মিষ্টি জলের সন্ধানে সে এসেছে এখানে, বাঁচার তাগিদ নিয়ে। গঙ্গাবক্ষে বাবুঘাটের কাছাকাছি তার ঠিকানা। আরও কিছু কেওড়া গাছ দেখা যায় গোদাখালির গঙ্গার পাড়ে, সাতগাছিয়া অঞ্চলে। যেখানে নাদীর মিষ্টি জল বাঁক নিয়ে ঘেরার মধ্যে থেকেছে। ওদের ফুল ফল হয়। এরা এখন ‘এনভায়রনমেনটাল রিফুজী’।
ওড়া লম্বা ও বড় হয়। এদের সংখ্যা খুব কম। রাক্ষসখালিতে কিছু গাছ এখনও বেঁচে আছে। গাছের শাখা প্রশাখা কম, কাণ্ডটি সোজা বাড়তে থাকে। গাছটি বেশ উঁচু হয়। ফুল কম ফোটে। এদের পাতার রঙ ঘন সবুজ। এদের ফল গোল-চ্যপটা। এদেরও চারাগাছ প্রায় দেখা যায় না। এরাও সুন্দরবন থেকে বিদায় নিতে তৈরি।
টক কেওড়া গাছ সুন্দরবনের অতি পরিচিত নাম। ফুলে পাপড়ি থাকে না। এদের থোকা থোকা প্রচুর ফল হয়। ডালপালা থেকে ফলগুলো নিচে ঝুলতে থাকে। ফল ছোট ছোট ও গোলাকার। এর ফল খাওয়ার তালিকায় রয়েছে বিচিত্র সব খাদক– মানুষ, গরু, ছাগল, ভেড়া, বাঁদর, ও পাখিরা। কীট পতঙ্গের কথা আর নাই বা বললাম। এদের ফলে সুস্বাদু চাটনি হয়। এই চাটনি সুন্দরবনের মানুষের খুব প্রিয়। তাই অনেকের বাড়ির উঠোনে টক কেওড়া গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়াও, সব প্রজাতির কেওড়ার অনেকরকম গৃহস্থালীর ব্যবহার আছে। কেওড়ার ডালপালা, পাতা, কাণ্ড ও মূলের ব্যবহার সুন্দরবনের সব অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। এদের নরম ডালপালা ও পাতা গবাদি পশুর উপাদেয় খাদ্য। কাণ্ড খুঁটি ও দালানের কাঠামো বানাতে ব্যবহার করা হয়।
‘নিশীথে যাইও ফুল বনেরে, ভ্রমরা, নিশীথে যাইও ফুল বনে’। রাতের বেলায় কেওড়ার পরাগ সংযোগ হয়। মধ্যস্থতাকারি অতিথিরা ভিন্ন ধরনের। বাদুড়, চামচিকে, ও মথ। এরাই পরাগ সংযোগ ঘটায়। শোনা যায়, রাতের পাখিরাও এই কাজে অংশ নেয়। এদের পাপড়িগুলো কচি অবস্থায় ঝরে যায়। অনেকের আবার পাপড়ি নেই বললেই চলে। পুং রেণুদণ্ড উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়। গর্ভদণ্ড লম্বা, এমনকি রেণু দণ্ডের চেয়ে ও লম্বা হয়। এরা রেণু গ্রহণের জন্য ব্যাকুল থাকে। কেওড়া প্রজাতির ফল দেখা যায়, কিন্তু চারাগাছ প্রায় দেখাই যায় না।
সমস্ত প্রজাতির কেওড়াই প্রায় পরিবেশ স্পর্শকাতর। দূষণ সূচক হিসেবে এদেরকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পরিবেশে লবণের মাত্রা বাড়লে এদের টিকে থাকা মুশকিল হয়। আই পি সি সি প্রতিবেদন ২১ (ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ২১) প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে সুন্দরবনের মতো নিচু এলাকাগুলো খুবই সংবেদনশীল বলে দেখানো হয়েছে। পরিবেশের তাপমাত্রার মাত্রা আরও বাড়ার সম্ভাবনা আছে। সার্বিকভাবে বাদাবনের অস্তিত্বও সংকটে। আরও বেশি সংকটে সমস্ত প্রজাতির কেওড়ার অস্তিত্ব। এরা বেশি লবণ জলে বাঁচতে পারে না। উষ্ণায়ণ বাড়লে, সমুদ্রের জলের উপরিতল বাড়বে, আর তাতেই বিপদ। সুন্দরবন আরও বেশি পরিমাণ নোনা জলে প্লাবিত হবে। কেওড়ার প্রজাতিরা এরই মধ্যে অভিযোজন না করে নিতে পারলে সুন্দরবন থেকে চির বিদায় নেবে।
বাংলাদেশে কপোতাক্ষ নদী, সাতক্ষীরা-র পাড়ে চাক কেওড়া দেখতে পাওয়া যায়। তবে আর কতদিন এরা বেঁচে থাকবে জানা নেই। আমাদের একদিন বলতে হবে ‘হে পথিকবর জন্ম যদি তব’ এ সুন্দরবনে, ‘দাঁড়াও ক্ষণকাল’। ব্যথিত কবি মধুসূদন দত্তের আক্ষেপ মিলিয়ে নেওয়া যায় কেওড়ার গাছের অস্তিত্বকে শেষ বিদায় দেবার সময়।
(চলবে)