কানাডার সুদূর উত্তরে, নুনাভুটের লং আইল্যান্ডে, বহু বছর আগে মাটির নীচে চাপা পড়ে ছিল একটি পুরোনো দাঁত। সম্প্রতি আবিষ্কৃত এই একটি মাত্র প্রাচীন দাঁতই বিজ্ঞানীদের ভাবনার জগতকে দিল নতুন রূপ।
গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, এটি কোনো সাধারণ প্রাণীর নয়, বরং এক উলি ম্যামথের দাঁত। এ হল বরফযুগের সেই বিশাল, লোমশ হাতির দাঁত যারা হাজার বছর আগে পৃথিবীর তুন্দ্রা অঞ্চলে (শীতপ্রধান অঞ্চল) বিচরণ করত। এ আবিষ্কার জানাচ্ছে, এরা শুধু সাইবেরিয়া বা মধ্য কানাডাতেই নয়, পূর্ব কানাডার উপকূল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াত।
এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে উত্তর-পূর্ব দিকের ম্যামথ জীবাশ্ম। আগে এটিকে দক্ষিণের কোনো ম্যামথ প্রজাতির দাঁত মনে করা হয়েছিল। কিন্তু বিশদ বিশ্লেষণে জানা যায়—এটি ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকা প্রজাতি ম্যামুথাস প্রিমিজিনিয়াস-এর। এই গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন লুই-ফিলিপ বাতেমান, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের তরুণ গবেষক। ইনি বরফযুগের প্রাণী ও জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন।
দাঁতের গঠন ও আকার ছাড়াও বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করেছেন এর ভেতরের কোলাজেন প্রোটিন ও কার্বন-নাইট্রোজেন আইসোটোপ। এই বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় ম্যামথটি ঠান্ডা অঞ্চলের ঘাস ও ভেষজ উদ্ভিদ খেত, কিন্তু মৃত্যুর আগে ভয়াবহ খাদ্যাভাব বা পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল। নাইট্রোজেনের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত—প্রাণীটি নিজের শরীরের টিস্যু ভাঙতে শুরু করেছিল বাঁচার শেষ প্রচেষ্টায়।
দাঁতের বাইরের এনামেল স্তরে থাকা অক্সিজেন আইসোটোপ জানাচ্ছে, প্রাণীটি প্রায় ২°C গড় তাপমাত্রার এক তুলনামূলক উষ্ণ সময়কালে বাস করেছিল—প্রায় ১,২৫,০০০ বছর আগে, বরফযুগের মাঝামাঝি এক উষ্ণ পর্বে। তখন হাডসন ও জেমস উপসাগর অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে উন্মুক্ত তৃণভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ফলে ম্যামথেরা সহজে এখানে খাদ্য পেত এবং ফিরে পেয়েছিল পূর্বদিকে অবাধ চলাচলের সুযোগ।
এই দাঁত প্রমাণ করছে, বরফযুগে ম্যামথেরা ছিল অত্যন্ত গতিশীল অভিবাসনকারী যাত্রী। আবহাওয়া উষ্ণ হলে তারা উত্তরে ও পূর্বে ছুটে যেত, আবার ঠান্ডা বাড়লে দক্ষিণে ফিরে আসত। এমনকি জিন গবেষণায় দেখা গেছে সাইবেরিয়া ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে তারা বহুবার চলাচল করেছিল বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ পেরিয়ে।
সবচেয়ে আশ্চর্যর বিষয়টি হল—এই অভিবাসন ও অভিযোজনের জীবন্ত সাক্ষ্য দাঁতটি দশকের পর দশক ধরে সংগ্রহশালার এক কোণে পড়ে ছিল। নতুন প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের কল্যাণে এখন এটি বরফযুগের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় উন্মোচন করছে। হয়তো এই সাধারণ দাঁতের মতোই আরো কত উদাহরণ লুকিয়ে আছে পৃথিবীর অতীতের অজস্র অনাবিষ্কৃত গল্প নিয়ে।
সূত্র: Age, stable isotopes, and redescription of the first mammoth tooth from the Labrador Peninsula by : L.-P. Bateman. 20th October ,2025.
https://orcid.org/0000-0003-4154-8200
