মৎস্যকন্যার বটুয়া’য় জীবন্ত ডিম

মৎস্যকন্যার বটুয়া’য় জীবন্ত ডিম

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপের উপকূলে, সমুদ্রের নীচে এক সক্রিয় আগ্নেয়গিরির মধ্যে হাজার হাজার বিশাল সজীব ডিমের খোঁজ পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার গভীর সমুদ্রের প্রাণীদের রহস্যময় জীবনচক্র এবং চরম পরিবেশে বিকাশমান অসাধারণ এক বাস্তুতন্ত্রের হদিশ দেয়। ‘মারমেইডস পার্স’ বা ‘মৎস্যকন্যার বটুয়া’ নামে পরিচিত এই ডিমগুলি, রহস্যজনক এক সামুদ্রিক প্রজাতির, প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা ‘স্কেট’ এর। কানাডার দ্বীপের উপকূলবর্তী এই বিরল আবিষ্কার, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র এবং গভীর সমুদ্রে প্রাণীদের জীবনচক্র সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুন আকার দেয়। দ্বীপের কাছাকাছি জলতলের এই আগ্নেয়গিরি যুগ যুগ ধরে ‘সুপ্ত’ বলে মনে করা হতো। ২০১৯ সালে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী চেরিস ডু প্রিজের নেতৃত্বে পরিচালিত এক অভিযানের সময় এটি নাটকীয়ভাবে পুনরুত্থিত হয়। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৩৬০০ ফুট উঁচু এই সামুদ্রিক পর্বতটি সমুদ্রপৃষ্ঠের ০.৯৩ থেকে ০.৯৯ মাইল নীচে অবস্থিত। অভিযাত্রীরা আবিষ্কার করেন আগ্নেয়গিরিটি উষ্ণ এবং খনিজ সমৃদ্ধ জল নির্গত করে। অপ্রত্যাশিতভাবে বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে এটি লালন করে চলেছে। এই ভূ-তাপীয় কার্যকলাপ ১৮ থেকে ২০ ইঞ্চি প্রস্থের বিশালাকার ডিমগুলির বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের গর্ভধারণের জন্য চার বছরের মতন অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। আগ্নেয়গিরির উষ্ণতা একটি প্রাকৃতিক তা দেওয়ার যন্ত্র বা ‘ইনকিউবেটর’ হিসেবে কাজ করে এবং ডিমের বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। তরুণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা স্কেটগুলির জন্য এটি নতুন সূচনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই ঘটনাটি, সমুদ্রের নীচের ভূতাত্ত্বিক এবং জৈবিক প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে জটিল সম্পর্কর বর্ণনা দেয়। এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা স্কেটের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বাথিরাজা স্পিনোসিসমা’। ঠান্ডা প্রশান্ত মহাসাগরীয় জলে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬০০ থেকে ৯৫০০ ফুট গভীরে এর বাস। স্ত্রী স্কেটগুলি বড় বড় ডিম পাড়ে তাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের জন্য যথেষ্ট শক্তি বিনিয়োগ করে। প্রাপ্তবয়স্ক স্কেটগুলি ৬.৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। আগ্নেয়গিরির অগভীর শিখর থেকে আসা উষ্ণতা একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে, যাকে ‘চেরিস ডু প্রিজ’ বলা হয়ে থাকে। এটি একটি প্রবাল বাগান । কিশোর স্কেটদের জন্য এটি একটি নিরাপদ লালনক্ষেত্রর ভূমিকা পালন করে। স্কেটগুলির প্রাথমিক জীবন পর্যায়ে, এই আগ্নেয়গিরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৮ সালে গালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জের কাছে এইরকমই একটি ঘটনা দেখা গিয়েছিল। সেখানে জলতাপীয় রন্ধ্রের কাছে ৪ ইঞ্চির থেকে বড় ডিম পাওয়া গিয়েছিল। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, ডিমে তা দেওয়ার সময়, বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রজাতির কাছে আগ্নেয়গিরির তাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ উৎস। ভূতাপীয় বৈশিষ্ট্য সমন্বিত এই উষ্ণতা এক অনন্য জীববৈচিত্র্যর অনুকূল। সামুদ্রিক প্রাণীর বিকাশের ক্ষেত্রে এটি কিরূপ প্রভাব ফেলে, তা বিজ্ঞানীরা বুঝতে চান। একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরিতে এই বিশাল ডিমের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, সমুদ্রের জীবনচক্রে জলের নিচের আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ সম্পর্কে পূর্বে যা ধারণা ছিল, এগুলি তার থেকেও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। এই ধরনের অন্তর্দৃষ্টি, গভীর সমুদ্রের কঠিন পরিস্থিতিতেও বাস্তুতন্ত্রগুলি কিভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে এবং তার উন্নতি ঘটছে, সেই সম্পর্কেও গবেষণার পথ খুলে দেয়। ২০২৩ সালের নতুন অভিযান, কানাডিয়ান অঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা স্কেটের ডিম পাড়ার সাক্ষী। এই রহস্যময় প্রজাতির প্রজনন আচরণ সম্পর্কে আরও তথ্য প্রকাশ বাকি। সামুদ্রিক সংরক্ষণ প্রয়াসে এই জলতলের বাস্তুতন্ত্রের জটিল গতিশীলতা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সক্রিয় আগ্নেয়গিরির মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের সাদা স্কেটের প্রজনন ক্ষেত্র আবিষ্কার এই ভঙ্গুর পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রের তাপমাত্রা বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলতে থাকায় এই অনন্য আবাসস্থলগুলি সংরক্ষণ করা আরও বেশি জরুরী হয়ে পড়ছে। গবেষক এবং সংরক্ষণবিদরা একসাথে কাজ করে সামুদ্রিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য তৈরি করতে পারেন। ভবিষ্যতের অনুসন্ধানগুলি, গভীর সমুদ্রের আরও লুকানো রহস্য উন্মোচন করতে পারে যা সমুদ্রের সাথে আমাদের সম্পর্কর পুনঃ বিবেচনায় সাহায্য করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 + 5 =