
এরিস্টটোলই প্রথম ব্যক্তি, যিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সময় কি?’ আর তিনি যে সিদ্ধান্তে এলেন, তা হোল, পরিবর্তনের মাপকেই সময় বলা যেতে পারে। প্রত্যেক বস্তুই অবিরত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন পরিমাপ করলেই সময় পাওয়া যাবে।
এরিস্টটোলের ধারনাটা খুব ভালো ছিলঃ সময় বলতে সেটাই বোঝায় যখন আমরা জিজ্ঞেস করি ‘কখন?’ ‘কত সময় পরে তুমি ফিরবে?’ – যার মানে ‘কখন তুমি ফিরবে?’ এই ‘কখনের’ উত্তর দিতে গেলে কিছু ঘটেছে এটা বলতে হবে। ‘আমি তিনদিন সময়ে ফিরব’ – এর মানে যাওয়া এবং ফেরার মাঝে সূর্য আকাশে তিনটে বৃত্ত সম্পন্ন করে। এতটাই সোজা ব্যাপার।
তাহলে, যদি কিছু পরিবর্তনই না হয়, কিছু যদি গতিশীল না হয়, তাহলে কি সময় থমকে দাঁড়ায়?
সময় যে থমকে দাঁড়ায় এটা এরিস্টটোল বিশ্বাস করতেন। যদি কোন কিছুরই পরিবর্তন না হয় তাহলে সময় অপরিবর্তিত থাকার কথা, কারন আমাদের অনুমান অনুযায়ী জিনিসের পরিবর্তন হলেই সময় মাপা যায়। আমরা দিন মাপতে পারি। যদি কিছুর পরিবর্তনই না হয়, তাহলে সেখানে সময় নেই।
কিন্তু, তাহলে কি নীরবতায় সময় আমাদের অনুসরন করে? ‘অন্ধকারে আমাদের শারীরিক অভিজ্ঞতা শুন্য।‘ এরিস্টটোল তাঁর ‘ফিজিক্স’ বইতে লিখলেন, ‘কিন্তু মনের ভেতরে কিছু পরিবর্তন হয়, সাথে সাথে আমরা অনুমান করতে পারি, সময় চলছে।‘ অন্যকথায় বললে, আমাদের মধ্যে সময়ের প্রবাহ তখনই অনুভব করতে পারি যদি কিছু চলন আমরা মাপতে পারিঃ চলনটা হয়ত আভ্যন্তরীণ………। চলনের মাপটাই সময়কে নির্দেশ করে।
নিউটন কিন্তু এই মতের সম্পূর্ণ বিপরীতে একটা ধারনা পেষন করলেন। ‘প্রিন্সিপিয়া’তে তিনই লিখলেন, ‘আমি, সবাই জানে বলে, সময়, স্থান, জায়গা, গতির কোন সংজ্ঞা দিচ্ছি না। কেবলমাত্র, একটা জিনিস আমি পর্যবেক্ষন করেছি যে সাধারন মানুষ সেই ব্যাপারগুলোর সম্পর্ক নিয়েই চিন্তা করে যে বিষয়গুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। এবং সেখান থেকে কিছু সংস্কার কাজ করে, যেখানে তারা — চরম এবং আপেক্ষিক, সত্যি এবং আপাত, আঙ্কিক এবং সাধারণ বিষয়গুলো আলাদা করতে পারে।‘
অন্যভাবে বললে, নিউটন একধরনের ‘সময়ের’ অস্তিত্ব স্বীকার করেছিলেন যেটা দিন এবং চলন মাপতে পারে (যেটা এরিস্টটোল বলেছিলেন – আপেক্ষিক, আপাত এবং সাধারন)। কিন্তু তিনি তার সাথে আরেকধরনের সময়ের কথা বলে তর্ক করেছেন। এই ‘সময়’কে ‘প্রকৃত সময়’ বলা হয়। ‘প্রকৃত সময়’ বস্তুর পরিবর্তনকে অগ্রাহ্য করে, স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হয়। নিউটনের মতে, যদি সমস্ত কিছুই গতিহীন হয়, এমনকি আমাদের মনও, তখনও সময় অবিরত চলতে থাকে। এই ধারনা এরিস্টটোল যা বলেছিলেন, তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত।
নিউটন বলেছেন, ‘প্রকৃত সময়’ সরাসরি অবারিত নয়, কেবলমাত্র গণনার সাহায্যে এটাকে মাপা যেতে পারে। দিন দিয়ে যে সময় মাপি, এটা সেই সময় না, কারন ‘স্বাভাবিক দিনগুলো’ সমান না। সাধারনভাবে দিনগুলোকে সমান হিসাবেই ধরা হয় এবং সময় মাপার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। নভোচররা আকাশের বিভিন্ন বস্তুর গতি অতি সূক্ষ্মভাবে মেপে দিনের এই অসমতা দূর করে।
তাহলে এরিস্টটোল না নিউটন, কে ঠিক? প্রকৃতির দুই সূক্ষ্ম এবং গভীর অনুসন্ধান সময় সম্পর্কে চিন্তা করার দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত পথ দেখাচ্ছে। দুজন বিরাট মানুষ যেন বিপরীত দিকে টানছেন। আমরা যে প্রশ্নটা করতে পারি, এই দুটোর মধ্যে কোনটা সময় সম্পর্কে ঠিক চিন্তাধারা যাতে আমরা বিশ্বকে ঠিকমতো জানতে পারি এবং কোনটি বেশি কার্যকরী?
এই দুই বিশাল মানুষের মাঝখান থেকে বেরোনোর উপায় এবং অদ্ভূতভাবে তাদের মধ্যে সঙ্গতি আনার জন্য তৃতীয় এক তত্ত্বের প্রয়োজন পড়ল। পরে আমরা সেই নিয়ে আলোচনা করব।