রংবাহারি পশমি আলো

রংবাহারি পশমি আলো

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৬ মে, ২০২৫

অস্ট্রেলিয়ায় ভূপৃষ্ঠের নীচের ইঁদুর, ব্যান্ডিকুট, পোসাম, বাদুড়, গাছ-ক্যাঙ্গারু এবং আরও অনেক প্রাণীর পশম বা লোমে অতিবেগুনি রশ্মি পড়লে চকচক করে। মাছ, পাখি এবং কিছু উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও এটি দেখা যায়। জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের লিন্ডা রেইনহোল্ডের নেতৃত্বে একদল গবেষক এই ফটোলুমিনেসেন্স বা আলোক-প্রভার পিছনের রসায়নটি বোঝার জন্য গবেষণা করেছেন। উত্তর অস্ট্রেলিয়ার সদ্যমৃত দীর্ঘনাসা বাদামী ব্যান্ডিকুট, কোল, তামাটে ল্যাজ-ঝোলা পোসাম, লুমহোল্টজের গাছ-ক্যাঙারু, ফ্যাকাশে রঙের মেঠো ইঁদুর এবং প্লাটিপাসের গা থেকে চেঁচে-নেওয়া পশম যাতে আলোয় ঝলসে না-যায় সেজন্য তাকে অ্যালুমিনিয়াম পাতে মুড়ে মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয়। তারপর দুটি জটিল পদ্ধতি প্রয়োগ করে পশমের আণবিক গঠন বিশ্লেষণ করা হয়।

অতিবেগুনি রশ্মিপাতে ব্যান্ডিকুটের পশম নানা রঙে ঝলসে ওঠে। গবেষকরা তার কারণ স্বরূপ আলোক-সংবেদি লুমিনোফোরদের শনাক্ত করার চেষ্টা করেন। তাঁরা দেখতে চাইছিলেন বিভিন্ন প্রজাতির ব্যান্ডিকুটের মধ্যে একই লুমিনোফোর উপস্থিত থাকে কিনা। দেখা গেল প্রাথমিকভাবে দু রকম লুমিনোফোর আছেঃ পরফাইরিন-জাত, আর ট্রিপ্টোফ্যানের বিপাকক্রিয়া-জাত।

এইসব প্রজাতির প্রতিটির আছে নিজস্ব আলোকস্বাক্ষর। অতিবেগুনি রশ্মি পড়লে পরফাইরিন থেকে বেরোয় গোলাপি আর কমলা আভা। ব্যান্ডিকুট আর পসামদের দেহে বেশ কয়েক ধরনের পরফাইরিন-জাত পদার্থর হদিশ মেলে।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, তামাটে ঝোপালো লেজওয়ালা পসামদের পশমনির্গত রঙের জন্য দায়ী সাদা আলোর এক গোলাপি আভা, যার সঙ্গে মিল আছে নীল গাছ থেকে নিষ্কাশিত কাপড়-কাচা নীলের। এই কারণে সাদা আলোতেই ওদের পশম থেকে একটা চমকপ্রদ গোলাপি ঝিলিক বেরোয়। এ ঘটনা আগে জানা ছিল না বিজ্ঞানীদের।
ট্রিপ্টোফান শরীরের পক্ষে অপরিহার্য এক অ্যামিনো অ্যাসিড। বিপাকক্রিয়ায় ভেঙে গিয়ে তা থেকে এমন কিছু পদার্থ বেরোয় যা থেকে আলো নির্গত হয় -প্রধানত হলুদ আর নীল। এদের কারণেই অতিবেগুনি আলো ফেললে ফ্যাকাশে রঙের মেঠো ইঁদুরদের পশম থেকে হলুদ আলো বেরোয়। অথচ অন্য প্রজাতিটির মধ্যে কিন্তু এদের লেশমাত্র আভাস পাওয়া যায়নি।
তবে সব স্তন্যপায়ীই এই ট্রিপ্টোফান-পরফাইরিন বিভাগের মধ্যে পড়ে না। যেমন গাছ-ক্যাঙারুর পশমে ৩৬৫ ন্যানোমিটার কম্পাঙ্কের আলো পড়লে তা থেকে অপরূপ এক হালকা নীল-বেগুনি-গোলাপি মিশ্র-আভা বেরোয়। এগুলির প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। পরফাইরিন থাকা সত্ত্বেও প্ল্যাটিপ্লাসের পশম থেকে আবার খুব চাপা রঙের সবজেটে-গোলাপি আলো বেরোয়। এত সব বিভিন্নতার কারণ জানা যাবে ভবিষ্যতে, আরও গবেষণার পরে।
স্তন্যপায়ীদের গায়ের পশমের এই রংবাহারের পিছনে তিনটি সম্ভাব্য কারণের কথা ভাবা হচ্ছে। এক, এটা হয়তো বার্তাজ্ঞাপনের পদ্ধতি, হুঁশিয়ারি কিংবা কামুফ্লাজ। দুই, হয়তো শরীরের বর্জ্য পদার্থ গায়ের লোম দিয়ে বেরিয়ে আসে। তিন, পশম হয়তো এক রকমের ভাগাড়, যেখানে শরীরের ঝরতিপড়তি পরফাইরিন ফেলে দেওয়া হয়।
তবে এত উপাত্ত (ডেটা) সংগ্রহ করার পরেও অনেক যৌগই এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও অনেক গবেষণা করবার জন্য তৈরি হচ্ছেন গবেষকরা।
এ গবেষণার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে প্লস পত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 + two =