রক্তচাপ মাপার ক্যালকুলেটর

রক্তচাপ মাপার ক্যালকুলেটর

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনকে বলা হয় “নীরব ঘাতক”। কারণ এটি সাধারণত কোনো লক্ষণ ছাড়াই শরীরে ক্ষতি করে চলে, আর শেষ পর্যন্ত হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা কিডনির ব্যর্থতার মতো প্রাণঘাতী সমস্যার দিকে ঠেলে দেয়। পৃথিবী জুড়ে প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ এ রোগে ভুগছেন, যার মধ্যে বছরে প্রায় এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ দুঃখজনকভাবে প্রতি পাঁচ জন রোগীর মধ্যে মাত্র একজনের হয়তো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, আর বাকি চারজনই কার্যকর কোনো চিকিৎসাই পান না । এই ভয়াবহ বাস্তবতায় গবেষকরা তৈরি করেছেন এক অসামান্য সরঞ্জাম, যা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নতুন পথ দেখাতে পারবে।

নতুন সরঞ্জামটির নাম “ব্লাড প্রেসার ট্রিটমেন্ট এফিকেসি ক্যালকুলেটর”। এটি তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৫০০টি র‌্যান্ডমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্যের ভিত্তিতে। সেখানে অংশ নিয়েছেন এক লক্ষেরও বেশি মানুষ। ক্যালকুলেটরটি ডাক্তারদের হাতে এমন এক শক্তিশালী উপায় তুলে দিয়েছে, যার মাধ্যমে সহজেই বোঝা যাবে কোন ডোজের ওষুধ দিলে রক্তচাপ কতটা কমানো সম্ভব হবে। অর্থাৎ একজন রোগীর জন্য কত মিলিমিটার রক্তচাপ কমানো দরকার, তার উপর ভিত্তি করে সবচেয়ে উপযোগী ওষুধ বা ওষুধের সমন্বয় বেছে নেওয়া সহজ হবে।

কার্ডিওলজিস্ট ড. নেলসন ওয়াং বলেছেন, প্রতি ১ মিমি রক্তচাপ কমলেই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রায় ২% হ্রাস পায়। কিন্তু বাস্তবে চিকিৎসকদের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো—অগণিত ভিন্ন ভিন্ন ডোজের ওষুধের মধ্যে থেকে রোগীর রক্তচাপের সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে সঠিক ওষুধ নির্ধারণ করা। কারণ, অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের হয়তো একাধিক ওষুধের প্রয়োজন। এত বিকল্পের ভিড়ে কোন সমাধানটি সবচেয়ে কার্যকর হবে, তা নির্ধারণ করা সত্যি কঠিন।

নতুন ক্যালকুলেটরটি এই জটিলতা দূর করতে সক্ষম। এটি ওষুধগুলোর কার্যকারিতা গড়ে মেপে কম, মাঝারি এবং বেশি তিনটি মাত্রার গ্রুপে ভাগ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রাথমিকভাবে একটি উচ্চরক্তচাপ রোধক ওষুধ (অ্যান্টি- হাইপাএরটেন্সিভ ড্রাগ) সাধারণত ৮-৯ মিমি পর্যন্ত রক্তচাপ (সিস্টোলিক অর্থাৎ হৃদযন্ত্রের সংকোচন জনিত চাপ) কমায়। কিন্তু যেসব রোগীর ক্ষেত্রে ১৫–৩০ মিমি পর্যন্ত কমানো দরকার, তাদের জন্য ডাক্তার সহজেই নির্ধারণ করতে পারবেন কোন সমন্বয়টি ব্যবহার করলে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে।

অ্যান্থনি রজার্সের মতে, এতদিন যে “স্টার্ট লো, গো স্লো” পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো অর্থাৎ ধীরে ধীরে ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দেখা হ ত, তা অনেক সময় বিভ্রান্তিকর । কারণ রক্তচাপ প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে। ফলে চিকিৎসায় দেরি হতো, রোগীরা বিরক্ত হতেন। কিন্তু নতুন ক্যালকুলেটরটি সেই পদ্ধতিকে বদলে দিয়ে চিকিৎসাকে আরও সরাসরি, দ্রুত ও কার্যকর করবে।

 

আগামী দিনে এই ক্যালকুলেটরের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বাস্তবে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ওপর বৃহৎ পরিসরে একটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হবে। বিশেষজ্ঞরা খুবই আশাবাদী। তাঁরা বলছেন এই ট্রায়ালটি সফল হলে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ উপকৃত হবেন। বেশি না, মাত্র ৫০% রোগীর রক্তচাপও যদি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তবে কোটি কোটি জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে। এই ক্যালকুলেটরটি শুধু একটি প্রযুক্তিই নয়, এটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যযুদ্ধে এক নতুন অস্ত্র। এটি উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো আবিষ্কার হতে চলেছে।

 

সূত্র: “Blood pressure-lowering efficacy of antihypertensive drugs and their combinations: a systematic review and meta-analysis of randomised, double-blind, placebo-controlled trials” by Nelson Wang, Abdul Salam, et.al; (30.08.2025), The Lancet.

DOI: 10.1016/S0140-6736(25)00991-2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 + four =