রদ্দাম নরসিংহ (১৯৩৩-২০২০) ছিলেন একজন বিমান-মহাকাশ বিজ্ঞানী ও তরলগতিবিদ্যাবিদ। অন্ধ্রপ্রদেশের রদ্দাম গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা আর এল নরসিংহ ছিলেন ব্যাঙ্গালোর সেন্ট্রাল কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক এবং কন্নড় ভাষায় পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার বিজ্ঞানলেখক। পিতার দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন রদ্দাম। ১৯৫৫ সালে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স থেকে এম এসসি করে তিনি ১৯৬১ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পি-এইচ ডি করেন। ১৯৫৭য় মহাকাশে রাশিয়ার স্পুটনিক উৎক্ষেপণের পর সেসময় আমেরিকায় মহাকাশ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ জেগে উঠেছিল। সেই সূত্রে তিনি হ্যান্স ডব্লিউ লিপম্যানের সঙ্গে কাজ করেন। ক্ষীণ অক্সিজেন সংবলিত rarefied গ্যাস এবং তরল গতিবিদ্যার দিকে মনোনিবেশ করেন । ওই ধরনের গ্যাসের প্রবাহতত্ত্বে নিম্ন চাপে প্রবাহের ক্ষেত্রকে নিয়ে নানা রকমের গাণিতিক মডেল নির্মাণ করা হয়। তিনি নাসা জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে এই গবেষণা চালিয়ে যান। সেখানে শক ওয়েভের গঠন নিয়ে অ্যারোডাইনামিক্স এবং সুপারসনিক প্রবাহ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন । সুপারসনিক(শব্দোত্তর ) প্রবাহগুলি প্রায়শই শক ওয়েভের উপস্থিতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যার ফলে প্রবাহের বৈশিষ্ট্য এবং স্ট্রীমলাইনগুলি অবিচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়। এই সময় তিনি মহাকাশ সংস্থার প্রথম কম্পিউটারগুলির একটিতে কাজ করেছিলেন।
১৯৬২ সালে তিনি ভারতে ফিরে এসে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। সেখানে টারবুলেন্ট (বিক্ষুব্ধ, এলোমেলো) প্রবাহ নিয়ে এবং টারবুলেন্ট থেকে ল্যামিনার (সমান্তরাল) প্রবাহ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। ১৯৭০ সালে সতীশ ধাওয়ানের যে গবেষক দলটি AVRO ৭৪৮ বিমানের কাজকর্ম পরীক্ষা করেছিল তিনি তার সদস্য ছিলেন। ন্যাশনাল অ্যারোস্পেস ল্যাবরেটরিতে থাকাকালীন নরসিংহ তরল গতিবিদ্যার সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে সমান্তরাল গণনার (Parallel computing) গবেষণায় নেতৃত্ব দেন । তাত্ত্বিক কম্পিউটার বিজ্ঞানে সমান্তরাল গণনা একটি বিশেষ ধরনের গণনা যেখানে অনেকগুলো গণনার প্রক্রিয়া একই সঙ্গে চালানো হয়। আই বি এম-র ব্লু জিন সুপারকম্পিউটার উৎকৃষ্ট মানের সমান্তরাল গণনা করে থাকে। তাঁর প্রচেষ্টায় ভারতে প্রথম সমান্তরাল কম্পিউটার নির্মাণ নিয়ে গবেষণা হয়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য একটি কোড তৈরি হয়। হালকা যুদ্ধ বিমানের নকশা-নির্মাতা দলের তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ছয় দশকের দীর্ঘ একাডেমিক কর্মজীবনে তিনি মৌলিক এবং ফলিত তরল গতিবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ল্যামিনার (সমান্তরাল) এবং টারবুলেন্ট প্রবাহের (বিক্ষুব্ধ গতির) শক ওয়েভের গঠন, পূর্ণ বিকশিত টারবুলেন্ট প্রবাহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য (যেমন তাদের স্মৃতি, সীমানা স্তরে বিস্ফোরণ), মেঘের তরল গতির মধ্যে পরিবর্তন প্রভৃতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। এছাড়া কাছাকাছি-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বন্টন এবং বায়ুমণ্ডলীয় সীমানা স্তরে উল্লম্ব বিক্ষুব্ধ বায়ুপ্রবাহ পরিমাপ (এডি ফ্লাক্স) নিয়ে কাজ করেছেন। রিল্যামিনারাইজেশনের (পুনরায় সমান্তরাল প্রবাহে ফিরে আসা) অত্যাধুনিক পরিমাপ করেছেন। টারবুলেন্ট থেকে ল্যামিনারে রূপান্তরিত হওয়ার প্রবাহপথ নিরূপণ এক অনন্য কৃতি। নরসিংহের আরও প্রসিদ্ধ অবদানগুলির মধ্যে একটি হল তেজসের উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা। এখানে তৈরি একটি হালকা যুদ্ধ বিমান, উপকরণ প্রকৌশল এবং কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডাইনামিকসের মতো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সূচনা করেছে।
দুশোটিরও বেশি গবেষণাপত্র এবং পনেরোটি বিখ্যাত একাডেমিক বইয়ের লেখক হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিজ্ঞান-নীতি এবং সংস্কৃতি বিষয়ে লিখেছেন, কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর অনেক ছাত্র এখন তাঁদের নিজ অধিকারে আন্তর্জাতিক স্তরে অসামান্য গবেষক। যেমন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে আর শ্রীনিবাসন বা আই সি টি এস ব্যাঙ্গালোরের অধ্যাপক রমা গোবিন্দরাজন। ২০১৯ সালে নেচার পত্রিকা শিষ্য তৈরি করার (মেন্টরিংয়ের) জন্য তাঁকে জীবন কৃতি পুরস্কার প্রদান করে।
নরসিংহ ছিলেন আমেরিকান একাডেমি অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের সম্মানিত সদস্য, লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনটিক্সের সদস্য।