রাজার জন্ম
(এক কোটি বছর আগে ডোরাকাটা বিড়ালের জন্ম বৃত্তান্ত শুরু হয়। ক্রমশ ভৌগলিক বিস্তারের সঙ্গে বাঘ জঙ্গলের আধিপত্য কায়েম করে। আজ সেই ক্যারিশম্যাটিক প্রাণীটি বিলুপ্তির মুখে। বাঘের রাজকীয় বিস্তার ও বিবর্তনকে ফিরে দেখা নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ প্রথম কিস্তি।)
টাইটানিকের জ্যাক কে মনে আছে? রোজকে বাঁচাতে ভালোবাসার জন্য আত্মত্যাগ দেখে পৃথিবীবাসী চোখের জল ফেলেছিল। টাইটানিকের জ্যাক বাঘকে বাঁচাতে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড বা ডাবলু ডাবলু এফ কে এক মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য করেছিল। সেন্ট পিটার্সবার্গ রাশিয়া ২০১০ নভেম্বর মাস, পৃথিবীতে তেরো দেশ যেখানে বাঘ পাওয়া যায় এবং সঙ্গে সংগঠক দেশ রাশিয়াকে নিয়ে বসেছিল টাইগার সামিট। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে জ্যাক থুড়ি লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর এই বিপুল অর্থ সাহায্য পৃথিবীবাসীর চোখে আবারও জল এনে ছিল তবে সেটা আনন্দাশ্রু। নায়কোচিত। ২০১০ সাল থেকেই ২৯ জুলাই টাইগার ডে। বাঘের নামে বিশেষ দিন। সেই সামিট বলেছিল ২০১০ এ বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা বত্রিশশো এবং ২০২২ সালের মধ্যে তাকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে। ২০২১ এর ২৯ জুলাই, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিবেশ উৎফুল্লিত ভাবেই ঘোষণা করলেন বর্তমানে পৃথিবীতে বাঘেদের সত্তর শতাংশ ভারতীয়। ২০১০ এ রাশিয়ান টাইগার সামিটের সময় ভারতবর্ষে বাঘের সংখ্যা ছিল চোদ্দোশো এগারো। ব্যক্তিত্বশালী প্রাণী হিসেবে বাঘের কদর বিশ্বজোড়া। রাজকীয় চলাফেরা, খেয়ালী মেজাজ এবং গর্জনে জঙ্গল ত্রস্ত। ভারতে বাঘের আদি জন্মস্থান নয়, তবে ভারতে বাঘ এলো কি করে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, অ্যানিমেল প্লানেটে চোখ রাখলে সিংহ, হায়না, চিতা সহ সমস্ত হিংস্র মাংসাশী প্রাণীদের আফ্রিকায় দেখা মিললেও বাঘের অনুপস্থিতি মনে জাগায় প্রশ্ন। আফ্রিকায় কেন নেই বাঘ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় চিতাবাঘ থাকলেও বাঘ সিংহের গর্জন জঙ্গল শোনেনি। কেন?
কার্নিভরা। ফেলিফরমিয়া মানে বিড়াল জাতীয় ও ক্যানিফর্মিয়া কুকুর জাতীয় প্রাণী। এদের আমরা চোখে দেখে সহজে পার্থক্য করলেও বিজ্ঞান পার্থক্য করে কানের মধ্যে ছোট ছোট হাড় এবং মাথার খুলির গঠনে। কুকুর জাতীয় প্রাণীদের বিস্তার সারা পৃথিবীতে বেড়াল মূলত আফ্রিকা এবং এশিয়া জুড়ে তবে হায়নার দেখা আমেরিকাতেও মেলে। আজ থেকে প্রায় চার কোটি বছর আগে বিড়াল এবং কুকুর এই দুটি প্রজাতি পার্থক্য ঘটে। প্রসিলুরাস হল প্রথম দিককার বিড়াল জাতীয় প্রাণী যাদের অস্তিত্ব ছিল প্রায় তিন কোটি বছর আগে। এরা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত এবং অতর্কিত আক্রমন করে শিকার করতো, প্রয়োজনে গাছে উঠতে পারদর্শী ছিল। গাছে ওঠার সেই ক্ষমতা এবং শিকার করার অভ্যাস গৃহপালিত বিড়াল গুলিতে আজো বর্তমান। বিড়াল পরিবারে ৩৫ প্রজাতির সদস্য, তবে বাঘেদের পাঁচটি প্রজাতি। বাঘ, চিতাবাঘ, জাগুয়ার, স্নো লেপার্ড ও সিংহ। ভারতীয় বাঘের বিজ্ঞানসম্মত নাম প্যান্থেরা টাইগ্রিস। বিবর্তনে প্যান্থেরা পরিবারের সাদৃশ্য অনুসারে দুটি উপদল আছে। সিংহ এবং জাগুয়ার একটি দল অন্যদিকে বাঘ আর স্নো লেপার্ড। প্যান্থেরা পরিবারের উৎপত্তি সম্ভবত মধ্য এবং উত্তর এশিয়ায়। প্রায় এক কোটি বছর আগে অন্যান্য সমস্ত বিড়াল প্রজাতির প্রাণী থেকে প্যান্থেরা গ্রুপটি আলাদা হয়ে যায়। তারও বেশকিছু লক্ষ বছর পর, প্রায় ৮0 লক্ষ বছর আগে ক্লাউডেড লেপার্ড নামক এক বিশেষ ধরনের চিতাবাঘ থেকে বাঘেরা আলাদা হয়। তবে বাঘেদের আবির্ভাব ৬৫ লক্ষ বছর আগে। স্নো লেপার্ড এর থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র বাঘ হিসেবে প্রকাশ পেতে সময় লাগে আরো কুড়ি লক্ষ বছর। বিড়াল প্রজাতির অন্যান্য সদস্য মধ্য এশিয়াতে বিবর্তিত হয়েও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তবে বাঘেদের বিস্তার মূলত সমগ্র এশিয়া এবং ইউরোপের কিছু অংশ জুড়েই। তারা অজানা কোন কারনে আফ্রিকায় যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি অথবা গিয়েও থাকার উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে বিলুপ্ত হয়েছে। মধ্য এশিয়াতে বিবর্তিত হওয়ার পরে প্রায় এক কোটি বছর ধরে সমগ্র এশিয়া মহাদেশের বাঘেরা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল, তবে ভারতে বাঘের প্রবেশ সম্ভবত ষোলো হাজার বছর আগে উত্তর এশিয়া থেকে। এগারো হাজার বছরের আগে বাঘের কোন ফসিল ভারতবর্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। আবার এগারো হাজার পাঁচশ বছর আগে ভারতের সাথে শ্রীলংকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে ল্যান্ড ব্রিজ। শ্রীলঙ্কায় বাঘ অনুপস্থিত, সর্বোচ্চ শিকারি চিতাবাঘ। তবে সাম্প্রতিক কালে শ্রীলঙ্কায় বাঘের ফসিলের খোঁজ মিলেছে। ফসিলের বয়স নির্ধারণ করে জানা গেছে ষোলো হাজার পাঁচশো। এশিয়া থেকে বাঘেদের শ্রীলঙ্কা যাওয়ার একমাত্র রাস্তা ভারতবর্ষ হয়েই। তবে কি ভারতবর্ষে বাঘের আগমন ষোলো হাজার বছরের অনেকটা আগেই?
(ক্রমশ)