বিপন্নতা ভুলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রাজা
(এক কোটি বছর আগে ডোরাকাটা বিড়ালের জন্ম বৃত্তান্ত শুরু হয়। ক্রমশ ভৌগলিক বিস্তারের সঙ্গে বাঘ জঙ্গলের আধিপত্য কায়েম করে। আজ সেই ক্যারিশম্যাটিক প্রাণীটি বিলুপ্তির মুখে। বাঘের রাজকীয় বিস্তার ও বিবর্তনকে ফিরে দেখা নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ চতুর্থ ও শেষ কিস্তি।)
পয়লা এপ্রিল ১৯৭৩। ভারতীয় বাঘেদের জন্মদিন। স্বাধীনতার ঠিক পরে ভারতবর্ষের জীব বৈচিত্র এবং বাস্তু তন্ত্র কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে ক্রমশ উদাসীন হতে থাকে ভারতীয়রা। ১৯৭২ এ বাঘ গুনতে দেখা গেল মাত্র ১৮২৭। স্বাধীনতার আগেই ইংরেজ সৈন্যরা তাদের বন্ধুকের ট্রিগার কে খুশি করে চলেছিল যথেচ্ছ, মনস্থির করেছিল যা কিছু স্থির নয় তাকেই করতে হবে গুলি। স্বাধীনতার পরে তরাই অঞ্চলের বসবাসের জন্য বন্দুকধারী ভারতীয়রা নির্বিচারে বাঘ মারতে শুরু করেছিল। হাজার ১৯৭২ এ ভারতবর্ষে তৈরি হল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন আর সেই আইনের মধ্যেই বাঘেদের নবজন্ম দেওয়ার একটা সোনালী সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল। সেই সম্ভাবনা প্রসব করলো প্রজেক্ট টাইগার। ভারতবর্ষের নটি জাতীয় উদ্যান নিয়ে বাঘেদের লালন পালন, পরিচর্যা এবং বন্য বাসস্থান ফিরিয়ে দেওয়া হলো প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য। কানহা, করবেট, কাজিরাঙ্গা, মধুমালাই, বন্দিপুর ছিল প্রধান পাঁচ। ১৯৭৮ এ যুক্ত হলো সরিষ্কা আর কেরলের পেরিয়ার। সাফল্য এসেছিল হাতে হাতে সংরক্ষণ শুরু করার ছয় বছরের মধ্যেই বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ছয় সহ ভারতবর্ষে একান্নটি টাইগার রিজার্ভ।
পন্ডিত নেহেরু দেরাদুনের জেলে থাকাকালীন কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে সেলিম আলীর লেখা ইন্ডিয়ান বার্ডস বইটি পাঠিয়ে ছিলেন, অবশ্য তার অনেকটা আগে থেকেই ইন্দিরা দিল্লি ব্ল্যাক বার্ড ক্লাবের মেম্বার। এই ঘটনা ইন্দিরা গান্ধীর জীবনে ভাবনা নিয়ে আসে অন্য পৃথিবীর। সত্তরের দশকে দিল্লির চাণক্য বাজারে বিক্রি হয়েছিল বাঘ সিংহ চিতাবাঘ সহ ব্যাজারের চামড়া। নির্ভীক ফরেস্ট অফিসার, কৈলাশ সংখ্যাল, এক মহিলা সাংবাদিককে নিয়ে চোরাশিকারের নগ্ন চিত্রকে সেদিন বেআব্রু করেছিল। ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টারের মস্তিষ্কপ্রসূত প্রজেক্ট টাইগার ভারতবর্ষের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের মাইলস্টোন। ভালমিক থাপারের লেখায় ইন্দিরা গান্ধীকে তুলনা করলেন বন্য প্রাণের রক্ষাকর্তা হিসেবে “সেভিয়ার অফ ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ডলাইফ”। প্রতিপত্তিশালী আরব শেখদের হুবারা বাস্টার্ড হত্যা বন্ধ করলেন। কেরলের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ হল। ছাত্রছাত্রীদের দাবি মেনে দিল্লির আরাবল্লীর বেঁচে থাকা অরণ্য খন্ডকে রক্ষা করলেন। সাংবাদিক পিটার জ্যাকসনের মুখে শুনলেন হরিয়ানার সুলতান ঝিলে পাখি বৈচিত্রের কথা, জাতীয় উদ্যানে পরিণত হল সুলতান ঝিল। উদ্বিগ্ন ছিলেন সাইবেরিয়ান ক্রেনের ভরতপুরের ক্রমহ্রাসমান সংখ্যা নিয়ে, তদারকি করতে শুরু করেন নিজেই। আর সেই অকুতোভয় ফরেস্ট অফিসার কৈলাশ সংখ্যাল হলেন প্রজেক্ট টাইগারের ডাইরেক্টর। ভরতপুরে বৃদ্ধ বার্ড গাইডের কাছে একটা গল্প শোনা গিয়েছিল, ম্যাডাম গান্ধী গিয়েছেন ভরতপুরে পাখি দেখবেন বলে, গার্ড নিলেন সঙ্গে। সেই গার্ড স্মৃতিচারণায় বলছেন” আমি পাখি দেখালাম আর কই, ম্যাডামই আমি তো আমাকে গাইড করলেন”। প্রায় ৯০টি পাখি চিনে তার নাম বলেছিলেন। সেভিয়ার অফ ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ডলাইফ – যথার্থ নামকরণ।
১৯৪৮ এ গুজরাটের ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সদস্যদের চাপে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে এশিয়াটিক লায়নকে জাতীয় পশু হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৭২ এর ন্যাশনাল বোর্ড অফ ওয়াইল্ডলাইফ মিটিংয়ে সিংহ নয় বাঘকেই জাতীয় পশুর স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তর্কে বলা হয় সিংহ কেবলই যে গুজরাটের গির অরণ্যে কিন্তু বেঙ্গল টাইগার ভারতবর্ষের ষোলটি রাজ্যে, সেইসঙ্গে বাঘের গুরুত্ব পৃথিবীব্যাপী অপরিসীম। বর্তমানে ভারতবর্ষে আঠারোটি রাজ্যে বাঘের দেখা মেলে। ২০০৫ এ গঠন করা হলো ন্যাশনাল টাইগার অথরিটি। এশিয়াটিক সিংহ কিন্তু বিপন্ন তালিকা সত্বর গঠন করা উচিত লায়ন কনজারভেশন অথরিটি।। বিশেষভাবে শিকারের গন্ধ বিশ্লেষণ করার জন্য বাঘেদের রয়েছে অর্গান অফ জ্যাকবসন। প্রায় শায়িত অবস্থায় মাথাটিকে সামান্য উঁচু করে মুখ খুলে ইষদ গোটানো জীভ বাইরে বের করে বাঘ নেয় পরিবেশের ঘ্রাণ। সেই গন্ধ বিশ্লেষণ করে বাঘ সহজেই বুঝতে পারে বাঘিনী বা প্রতিপক্ষ পুরুষ বাঘের উপস্থিতি। বিশেষ এই স্বভাবের নাম ফ্লেহমেন। ফিরছে বাঘ ফিরবে রাজকীয়তা। নিকট ভবিষ্যতে হয়তো লুকিয়ে রয়েছে অতীতের ‘ভ্যাললা বন’। (শেষ)