মেছো বিড়াল বা ফিশিং ক্যাট। রাজ্যের ওয়াইল্ড লাইফ বোর্ডের অন্যতম সদস্য, জয়দীপ কুণ্ডুর ভাষায় মানুষের সঙ্গে মেছো বিড়ালের সহাবস্থান ইতিহাসের প্রথম পাতা থেকে। কারণ, মানুষ আর মেছো বিড়াল, দুই প্রাণীরই পেট চালানোর অন্যতম উপাদান মাছ। মেছো বিড়াল মাছ খেয়ে পেট চালায়। মানুষের পেট শুধু মাছ খেয়ে চলে না। মাছের চাষ ও বিক্রির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক এক মানুষ। কিন্তু মেছো বিড়াল তো শুধু মাছ খেয়ে নিজে বাঁচে না। যে বিপুলসংখ্যক জলাশয় এখনও আমাদের রাজ্যে রয়েছে সেই জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রও কিন্তু তার ভারসাম্য রক্ষা করে পারে মেছো বিড়ালদের জন্য। জলাশয়গুলো, জলাভূমি, পুকুরগুলিই মেছো বিড়ালদের বাসস্থান।
সেই মেছো বিড়াল আজ বিলুপ্তপ্রায়! একসময় মেছো বিড়ালের সংখ্যা এই রাজ্যে যা ছিল সেটা কমতে কমতে এখন হাতে গোনার সংখ্যায় চলে এসেছে। কতগুলি মেছো বিড়াল সঠিকভাবে রাজ্যে এখন আছে সেটাও বলা যায়নি। ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে উলবেড়িয়ায় বিষ দিয়ে মেরে ফেলা তিনটি মেছো বিড়াল সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে উলবেড়িয়ার ফরেস্ট রেঞ্জার রাজেশ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমাদের জেলায় এখনও হাতে গোনা কয়েকটি মেছো বিড়াল রয়ে গিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সমস্ত জেলা থেকে মেছো বিড়াল মুছে গিয়েছে।” মেছো বিড়ালকে মেরে ফেলা নিয়েও রাজেশ মুখোপাধ্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ। বলেছেন, “যারা মারল তিনটে মেছো বিড়ালকে তারা জানল না মানুষেরই কী ক্ষতি করল।” মাছ চাষীদের বক্তব্য, তাদের কষ্ট ও পরিশ্রম দুটোই পণ্ড করে দেয় মেছো বিড়াল। পুকুর থেকে মাছ চুরি করে। এই প্রসঙ্গে জয়দীপ কুণ্ডু বলছেন, “মানুষ আজ এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে যে তাদের আর সহ্য হচ্ছে না মেছো বিড়ালদের। কিন্তু মানুষের সঙ্গে এই প্রাণীর সহাবস্থান বহু যুগ ধরে। মেছো বিড়ালদের জন্যই কিন্তু পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলোর বাস্তুতন্ত্র বজায় থাকে কিন্তু এই মেছো বিড়ালদের জন্যই। একসময় মেছো বিড়ালরা কিন্তু রাজ্যের সম্পদগুলোর মধ্যে ছিল। আজ আমাদের জন্যই তা বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছে।”
মেছো বিড়াল বা ফিশিং ক্যাট নিয়ে গবেষণা করা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্রাট চক্রবর্তীরও একই বক্তব্য, “মনিটরিংটা নিখুঁতভাবে করতে হবে। মেছো বিড়ালদের প্রজাতিই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই শুধু প্রশাসনিক নয়, সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে মেছো বিড়ালদের সংরক্ষণ করার জন্য।” সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা যে একদম হচ্ছে না তা নয়। উলবেড়িয়া ও অন্যান্য জেলায় সাধারণ মানুষের মেছো বিড়ালদের না মেরে তাদের সংরক্ষণ করার কথা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়।
বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণী পৃথিবীতে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় তাহলে তা হবে জলের ওপর মানুষের অধিকারের লড়াই নিয়ে। আর বিশ্ব উষ্ণায়নের কুপ্রভাব পৃথিবীতে থাকা জলের ওপর যেভাবে পড়ছে তাতে ভবিষ্যতে সমস্তরকমের জলাধার, জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। সেখানে মেছো বিড়ালদের মত প্রাণী আর বিভিন্নরকমের উদ্ভিদ প্রজাতির হাতেই বেঁচে থাকে জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র।
এবার সেটাও ধ্বংসের পথে! নিজেদের বাঁচার জন্যই মানুষ ফিশিং ক্যাট বাঁচিয়ে রাখুক।