আপনারা সকলেই নিশ্চয়ই পড়েছেন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছেন, গত ১১ই ফেব্রুয়ারি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পৃথিবীর পরীক্ষাগারে প্রথমবার টের পাওয়া গেছে বলে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন। খবরটা বেশ কিছুদিন থেকেই হাওয়ায় ভাসছিল, অবশেষে ঐদিন ভারতীয় সময় রাত নটায় সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করা হল যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মিলেছে। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন তো ছড়ালই, সাধারণ মানুষও মিডিয়ার কল্যাণে বাদ গেল না। যারা বিজ্ঞান বলতে শুধু আইনস্টাইনের নাম জানে, তারাও বুঝলো, একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু পাওয়া গেছে। এই শতাব্দীতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে তুলনীয় আবিষ্কার বলতে চার বছর আগে হিগস বোসনের কথা বলা যেতে পারে, তবে এবার ভাগ্য ভালো, লোকজন ঈশ্বর-টিশ্বর নিয়ে মাতামাতি করেনি, যদিও আইনস্টাইনকে ঈশ্বর বানাবার একটা চেষ্টা দেখা গেছে। এত রূপক আর অতিশয়োক্তির ভিড়ে আসল বিজ্ঞানটাই হারিয়ে যাবার অবস্থা; সুতরাং এইসব বাদ দিয়ে আসুন সেই বিজ্ঞানটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ জিনিসটা ঠিক কি? সেটা বুঝতে গেলে আমাদের একটু পেছন ফিরে যেতে হবে। সপ্তদশ শতাব্দীতে নিউটন প্রথম মহাকর্ষের তত্ত্ব দেন। তিনি বলেন যে দুটো বস্তু একে অন্যকে নিজেদের দিকে টানে, এটাই মহাকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ। বস্তু দুটোর ভর m ও M হলে আর তাদের দূরত্ব r হলে, বলের মান হল
F = GmM/r2
যেখানে G হল নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। দেখা গেল যে গ্রহ-উপগ্রহ সবাই এই নিয়ম মেনে চলছে, গ্রহণের সময় একেবারে নিখুঁতভাবে মিলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, সুতরাং এই তত্ত্ব মেনে নিতে কোন বাধা রইলো না।
একটা ছোটো তাত্বিক খুঁতখুঁতুনি কিন্তু রয়েই গেল। ধরুন আজ হঠাৎ করে পৃথিবী হাওয়া হয়ে গেল, মানে একদম শূন্যে বিলীন হয়ে গেল। চাঁদ কি সঙ্গে সঙ্গেই সেই বিপর্যয়টা টের পাবে, না কি তার একটু সময় লাগবে বুঝতে যে বিপদ ঘটে গেছে? নিউটনের মতে, সঙ্গে সঙ্গেই টের পাবে। একে ইংরেজিতে বলে action at a distance. কিন্তু পৃথিবী বিলোপের খবরটা কে বয়ে নিয়ে যাবে? আলোর চেয়ে বেশি বেগে তো কেউ যেতে পারে না, কাজেই পৃথিবী থেকে চাঁদে আলো পৌঁছতে যে সময়টুকু লাগে ততক্ষণ তো দেরি হওয়া উচিত। নিউটনীয় মহাকর্ষে এই বাহকের কোনো জায়গা নেই, যা হবে সবই তৎক্ষণাৎ হবে।
এই সমস্যাটা তড়িতের ক্ষেত্রেও ছিলো। দুটো তড়িৎ আধানের মধ্যে বল আমরা কুলম্বের সূত্র দিয়ে হিসেব করি, সেখানেও বিলম্বের কোনো জায়গা নেই। এদিক থেকে দেখতে গেলে নিউটনীয় মহাকর্ষ আর কুলম্ব সূত্র বেশ কাছাকাছি। তড়িতের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা সমাধান করেছিলেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল; তিনি দেখিয়েছিলেন যে এই খবরটা বয়ে নিয়ে যায় তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, যার বেগ আলোর বেগের সমান – আলো আসলে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই তরঙ্গ তৈরি হয় তড়িৎক্ষেত্র ও চৌম্বকক্ষেত্রের কম্পনের ফলে।
আইনস্টাইন মহাকর্ষের ধারণাটাকেই পালটে দিলেন। প্রথমে ১৯০৫ সালে দেখালেন যে সময় আর স্থান একে অন্যের থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, সময় আর স্থান মিলিয়ে আমরা চার মাত্রার জগতে বাস করি, যার তিনটে মাত্রা স্থানের আর একটা সময়ের। এই চারমাত্রিক জগৎকে আমরা বলবো দেশকাল।
এরপর তিনি যেটা করলেন, বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার তুলনা নেই বললেই চলে। তিনি বললেন, যাকে আমরা আসলে মহাকর্ষ বলে মনে করি, তা ওই দেশকালের জ্যামিতি বেঁকে বা দুমড়ে যাওয়ার ফল। ধরুন আপনার হাতে একটা কাগজ আছে, আর তাতে কিছু সরলরেখা আঁকা আছে। এবার আপনি কাগজটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিলেন, তাহলে সরলরেখাগুলো আর সরল রইলো না, বেঁকে গেলো। এবার মনে করুন একটা পিঁপড়ে ওই সরলরেখা ধরে চলছিলো। এখন আপনার মনে হতেই পারে যে পিঁপড়েটা বাঁকা পথে চলছে, অর্থাৎ যেন বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে তার চলার পথটা বাঁকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে তো আর আপনি পিঁপড়েটার ওপর কোনো বল প্রয়োগ করেন নি, শুধু কাগজের জ্যামিতিটা পালটে দিয়েছেন। আইনস্টাইন বললেন যে কোনো জায়গায় ভর থাকলে সেখানের দেশকালের জ্যামিতি বেঁকে যায়, তার ফলে সোজা রাস্তাও বাঁকা দেখায়, আর সেটাকেই আমরা মহাকর্ষ বলে মনে করি। কোনো জায়গায় কিছুটা শক্তির ঘনত্ব থাকলে তার আশপাশের জ্যামিতি কিভাবে বেঁকে যায়, সেটাই আইনস্টাইনের সমীকরণ, আর তার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক মহাকর্ষের তত্ত্ব।
স্কুলে ভেক্টর বলতে জানতাম যার তিনটে উপাংশ আছে, কিন্তু এখন সময়ের হিসেবটাও নিতে হবে, তাই এই দেশকালে ভেক্টরের চারটে মাত্রা থাকবে। একে লিখবো xµ = (t,x,y,z), তার মধ্যে প্রথম উপাংশ অর্থাৎ t-কে µ=0 দিয়ে সাধারণত লেখা হয়। বাকিগুলো µ=1,2,3. দুটো খুব কাছাকাছি বিন্দু, xµ আর xµ+dxµ এর দূরত্ব হল
ds2 = – c2 dt2 + dx2 + dy2 + dz2.
এই হিসেবটা যেখানে খাটে তাকে বলে সমতল দেশকাল। আইনস্টাইনের তত্ত্বে, সমতল দেশকাল মানে সেখানে কোনো ভর বা শক্তি নেই, অর্থাৎ মহাকর্ষও নেই। ভর থাকলে এই দূরত্বটা এত সহজে লেখা যায় না, যেমন বাঁকানো তলের ওপর (একটা গোলকের উপরিতলের কথা ভাবুন) পিথাগোরাসের জ্যামিতি খাটে না, ত্রিভুজের তিনটে কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি হয় না। সাধারণ গ্রহ বা নক্ষত্রের জন্যে এই বক্রতাটা খুব সামান্য, দেশকাল প্রায় সমতল বললেই চলে। একে আমরা বলবো weak gravity বা দুর্বল মহাকর্ষ। তবে মহাকাশে এমন জিনিসও আছে যারা দেশকালকে তীব্রভাবে দুমড়ে দেয়, যেমন নিউট্রন নক্ষত্র বা আরো বেশি করে, ব্ল্যাক হোল। এদের কথায় পরে আসছি।
এখানে যে কথাটা বলা উচিত তা হল যে এর ফলে নিউটন সাহেবের কৃতিত্ব একটুও কমলো না। দেশকালের বাঁক বা বিকৃতি যেখানে কম, যেমন আমাদের সৌরমণ্ডলে, সেখানে আইনস্টাইনের তত্ত্বের ফলের সঙ্গে নিউটনের ফলের কোনো তফাৎ নেই। সূর্যের খুব কাছে গেলে একটু তফাৎ ধরা পড়বে, কিন্তু আমরা তো আর অত কাছে নেই, কাজেই নিউটনের তত্ত্ব দিয়ে গণনা করলে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। ১৯১৯ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন সূর্যের খুব কাছ দিয়ে যাওয়া তারার আলোর বাঁক পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন যে আইনস্টাইনের গণনা নির্ভুল, নিউটনের তত্ত্বে গণনা করলে একটু অন্যরকম ফল পাওয়া যায়। এরপর থেকেই বিশ্বময় আইনস্টাইনের নাম ছড়িয়ে পড়লো, আর বিজ্ঞানী আর আইনস্টাইন সমার্থক হয়ে উঠলেন।
১৯১৬ সালে একটি প্রবন্ধে আইনস্টাইন দেখালেন যে দুর্বল মহাকর্ষের ক্ষেত্রে দেশকালের যে সামান্য বিকৃতি হয়, তা একটা তরঙ্গ সমীকরণ মেনে চলে। এর তুলনা হিসেবে আবার তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্রের কথা ভাবা যেতে পারে, যেখানে ম্যাক্সওয়েল দেখিয়েছিলেন যে স্কেলার ও ভেক্টর বিভবও (কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্ররা জানেন, এদের থেকেই তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্র পাওয়া যায়) এইরকম একটা তরঙ্গ সমীকরণ মানে। দেশকালের এই বিকৃতি তরঙ্গের আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, পুকুরে ঢিল ফেললে যেভাবে চারদিকে তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। এর নাম দেওয়া হল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মত, মহাকর্ষের খবর বয়ে নিয়ে যায় এই তরঙ্গ, আর এর বেগও আলোর বেগের সঙ্গে সমান। কেন আলোর বেগের সঙ্গে সমান, সেটা বোঝা শক্ত নয়, মহাকর্ষের পাল্লাও অসীম, সুতরাং আলোককণা ফোটনের মত এর কণাও ভরশূন্য, সুতরাং বেগও আলোর বেগের সমান। সবই ঠিক আছে কিন্তু মহাকর্ষের কোনো কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখনো পর্যন্ত খাড়া করা সম্ভব হয়নি, কবে হবে তাও কেউ জানে না, প্রায় একশো বছর ধরে এ নিয়ে চেষ্টা হবার পরেও।
মুশকিল হল, এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বড়োই ক্ষীণ, একে ধরা খুব শক্ত। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আদৌ আছে কিনা তা নিয়েই দীর্ঘকাল সংশয় ছিলো বিজ্ঞানীদের মধ্যে। এমনকি আইনস্টাইন নিজেও সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ পাঠালেন, যার মর্মার্থ হল, আসলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব নেই। এই সব পত্রিকায় প্রবন্ধ পাঠালে তা এক বা একাধিক বিজ্ঞানীদের কাছে যায় মতামত দেওয়ার জন্যে, এঁদের বলে রেফারি। রেফারিরা ছাপার যোগ্য মনে করলে তবেই প্রবন্ধ ছাপা হয়। অনেক সময় রেফারিরা কিছু সংশোধন প্রস্তাব করেন, সেগুলো লেখক গ্রহণ করলে প্রবন্ধ গৃহীত হয়। এ নিয়ম সবার জন্যেই প্রযোজ্য, কালকের গবেষক ছাত্র থেকে নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানী পর্যন্ত। আইনস্টাইনের ১৯৩৬ সালের এই প্রবন্ধটি রেফারি প্রত্যাখ্যান করেন, গণনায় কিছু ভুল আছে দেখিয়ে। ক্রুদ্ধ অপমানিত আইনস্টাইন প্রবন্ধটি ফিজিক্যাল রিভিউ থেকে প্রত্যাহার করেন এবং দীর্ঘদিন আর কোন প্রবন্ধ পাঠাননি। মজার কথা হল, এই প্রবন্ধটি যখন অন্য একটি পত্রিকায় ছাপালেন, দেখা গেলো তাতে রেফারির সমালোচনাগুলি গ্রহণ করেছেন, তার ফলে অন্তিম সিদ্ধান্তও পালটে গেছে। (আইনস্টাইন ব্যক্তিগত ইগোকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রশ্রয় দেননি – এটি একটি ব্যতিক্রম, কিন্তু আমাদের দেশে এ জিনিস ঘটলে পত্রিকার সম্পাদকের ঘাড়ে মাথা থাকতো না।)
বিজ্ঞানীরা এটুকুতে একমত হলেন যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ থাকলেও এতোই ক্ষীণ যে তাকে ধরা দুঃসাধ্য, অসম্ভবও বলা চলে। তড়িৎচুম্বকীয় বলের তুলনায় মহাকর্ষীয় বল অতি নগণ্য, অণু-পরমাণুর পারস্পরিক ক্রিয়া হিসেব করার সময় আমরা মহাকর্ষীয় বলকে উপেক্ষা করি। সুতরাং মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আইনস্টাইনের তত্ত্বের একটি অনুসিদ্ধান্ত হয়েই রইলো। তার মানে এই নয় যে আর কোনো তত্ত্ব এই তরঙ্গের কথা বলে না। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার সুযোগ এখানে নেই, এটুকু বলা যেতে পারে যে আইনস্টাইনের তত্ত্ব যে মৌলিক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে, সেই একই নীতির ওপর আরও কিছু প্রতিযোগী তত্ত্ব আছে, তারাও এই তরঙ্গের কথা বলে। যেমন রবার্ট ডিকে ও কার্ল ব্রান্সের তত্বের উল্লেখ করা যেতে পারে।
এমনিতে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেখতে পাবার কথাই নয়, যেমন শান্ত সমুদ্রের মধ্যে ঢিল ফেললে দশ মাইল দূরে তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না। ঢিল ফেললে বোঝা যাবে না কিন্তু সমুদ্রের তলায় কোনো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠে অগ্ন্যুৎপাত করলে বোঝা যাবে, কারণ আরো অনেক তীব্র আলোড়ন তৈরি হবে। তেমনি দেশকালের জ্যামিতিতে যদি কোনো ঘটনায় তীব্র বিকৃতি তৈরি হয়, তার প্রভাব বহু দূরে বসেও টের পাওয়া যেতে পারে।
পরোক্ষভাবে প্রমাণ আগেই পাওয়া গিয়েছিলো। মহাকাশে কিছু তারা দেখা যায় যারা একে অন্যের চারদিকে পাক খায়। এদের বাইনারি বা যুগ্ম নক্ষত্র বলা হয়। এরকম একজোড়া নক্ষত্রের প্রত্যেকের ভর বেশ বেশি আর আয়তন খুব কম হলে (এইরকম বিরাট ঘনত্বের নক্ষত্র মহাকাশে অনেক আছে, এরা মূলত নিউট্রন কণা দিয়ে তৈরি বলে এদের নিউট্রন স্টার বলে) পাক খাবার সময় এরা তীব্র মাত্রায় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে, তার ফলে এদের শক্তি ক্রমশ কমতে থাকে আর আবর্তন আস্তে হতে থাকে। সাধারণ যুগ্ম নক্ষত্রও এই তরঙ্গ বিকিরণ করে, কিন্তু তার মাত্রা এতই সামান্য যে পৃথিবীতে বসে তা ধরার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ১৯৭৫ সালে হালস এবং টেলর এরকম একটা নিউট্রন বাইনারি খুঁজে পান, আর ১৯৮২ সালে টেলর এবং ভাইসবার্গ দেখান যে এদের ঘোরার বেগ আস্তে আস্তে কমে আসছে। এটাকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম প্রমাণ বলা যেতে পারে, যদিও পরোক্ষ, কিন্তু এরপর থেকেই বিজ্ঞানীরা ভাবতে থাকেন যে পৃথিবীতে যন্ত্র বসিয়ে সরাসরি এই তরঙ্গের প্রভাব মাপা যেতে পারে কিনা।
আলোকতরঙ্গ দেখার অনেক উপায় আছে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেখার উপায় তার ধাক্কায় কোনো বস্তুর আকারের যে সামান্য বিকৃতি ঘটে তা মাপা। এই বিকৃতি খুবই সামান্য, একটা দণ্ডের দৈর্ঘ্য হয়তো পাল্টাবে এক কোটি কোটি কোটি (অর্থাৎ ১-এর পরে ২১টা শূন্য) ভাগের এক ভাগ। অকল্পনীয় রকম ছোটো, আর তাই এতদিন মাপা যায়নি। বিজ্ঞানীরা যন্ত্র বানিয়েছেন, ব্যর্থ হয়েছেন, আর বলেছেন, কুছ পরোয়া নেই, পরের বার আরো সংবেদী যন্ত্র বানাবো, যাতে আরো ক্ষীণ তরঙ্গ ধরা পড়ে। অনেকদিন ধরে এই চেষ্টার ফল লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি, সংক্ষেপে লাইগো (LIGO)।
বিজ্ঞানের ছাত্ররা কলেজে মাইকেলসন ইন্টারফেরোমিটার বলে একটা যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হন। লাইগো এরই অনেক উন্নত একটা সংস্করণ। এর মূল জিনিসটা বোঝার জন্যে একটা ছবি নিচে দেওয়া হল। একে দেখতে ইংরেজি L-অক্ষরের মত, এক একটা বাহু চার কিলোমিটার লম্বা। আমেরিকার দুপ্রান্তে, হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টনে, দুটো এইরকম L বসানো আছে। দুই বাহু বরাবর দুটো লেজার রশ্মি পাঠিয়ে আবার তাদের মিলিয়ে দিলে তার থেকে ধরা যায় যে বাহু দুটোর দৈর্ঘ্য সমান কিনা, আর এই মাপটা নেওয়াও যায় খুব নিখুঁতভাবে। বাহু দুটো সমকোণে থাকার ফলে এদের ওপর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এসে পড়লে তাদের দৈর্ঘ্য অতি সামান্য পালটাবে কিন্তু একরকমভাবে পালটাবে না। এই আলাদা পরিবর্তন লেজার রশ্মি দিয়ে ধরা যাবে। এতই নিখুঁত এই যন্ত্র যে কয়েক হাজার আলোকবর্ষের মধ্যে দেশকালের জ্যামিতিতে বিরাট কোনো আলোড়ন উঠলে যন্ত্রে তা ধরা পড়া উচিত।
চিত্র-১।লাইগোর বাহুদুটো ৪ কিমি লম্বা, বাহুর দুদিকে দুটো আয়না বসিয়ে আলোর চলার পথের দৈর্ঘ্য আরো বাড়ানো হয়। শেষে আবার দুই আলোকরশ্মিকে এক জায়গায় মিলিয়ে দেখা হয় অপবর্তন বা interference pattern-এর কোনো পরিবর্তন হল কিনা। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দুটো বাহুকে আলাদা ভাবে বিকৃত করে, তাই interference pattern সামান্য পালটে যায়।
চিত্র-২।দুটো ব্ল্যাক হোল একে অন্যের চারদিকে পাক খেতে খেতে ক্রমশ কাছে আসছে আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বিকিরণ করছে। ভয়ানক আলোড়ন উঠবে যখন তারা একসঙ্গে মিশে যাবে।
এইরকম আলোড়ন কিসের থেকে উঠতে পারে? ভয়ানক বিস্ফোরণে কোনো নক্ষত্র চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলেও এতটা আলোড়ন উঠবে না। এক হতে পারে দুটো ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর একসঙ্গে মিলে গেলে। ১০০ বছর আগে ১৯১৬ সালে কার্ল শোয়ার্তসচাইল্ড দেখিয়েছিলেন যে আইনস্টাইনের তত্ত্বের একটা অনুসিদ্ধান্ত হল ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি, তত্ত্ব ঠিক হলে এরা থাকতে বাধ্য। ব্ল্যাক হোল এক অকল্পনীয় ঘনত্বের জিনিস, নিউট্রন নক্ষত্রের চেয়েও অনেক বেশি, এতই তার পিঠের মাধ্যাকর্ষণের টান যে আলোও সে টান কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না, তাই তার নাম ব্ল্যাক হোল। (অনেক পরে স্টিফেন হকিং দেখান যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে ব্ল্যাক হোল থেকেও কিছু জিনিস বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু এখানে তার মধ্যে আমরা যাবো না।) ব্ল্যাক হোলের ঘনত্ব এত বেশি বলে তার চারপাশে দেশকালের জ্যামিতি এমনিতেই ভয়ানক দোমড়ানো। এরপর যদি একজোড়া ব্ল্যাক হোল যুগ্ম নক্ষত্রের মত একে অন্যের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে আর শক্তি ক্ষয় করতে করতে এ ওর ঘাড়ে এসে পড়ে আর মিলে যায়, তাহলে যে সাংঘাতিক আলোড়ন উঠবে তা বহুদূর থেকেও টের পাওয়া উচিত, ইন্দোনেশিয়ার সুনামি যেমন আমরা এদেশে বসেও টের পেয়েছিলাম।
চিত্র-৩।লাইগোর দুই যন্ত্রে ধরা পড়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। y-অক্ষে দেখানো হয়েছে বাহুর বিকৃতি, অর্থাৎ মূল দৈর্ঘ্যের কত অংশ পরিবর্তিত হয়েছে (y-অক্ষের সংখ্যাকে ১০-২১ দিয়ে গুণ করতে হবে)। প্রথমে তরঙ্গ ধরা পড়ে হ্যানফোর্ডে, তার প্রায় ৬ মিলিসেকেণ্ড পরে লিভিংস্টনে। দুই যন্ত্রের কম্পন একে অন্যের ওপর ফেলে বোঝানো হয়েছে যে এটা কোনো যন্ত্রের নিজস্ব সিগনাল নয়, সত্যিই বাইরে থেকে কিছু এসে আঘাত করেছে।
১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ লাইগোর দুটো যন্ত্রেই একটা অদ্ভুত সিগনাল ধরা পড়লো, যাকে এইরকম দুটো দানব ব্ল্যাক হোলের মিলে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। এর নাম দেওয়া হয়েছে GW150914, অর্থাৎ গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বিকিরণকারী অঞ্চল যা দেখা গেছে ১৪/০৯/২০১৫ তারিখে। প্রথমে এই সিগনাল ধরা পড়লো হ্যানফোর্ডে, তারপর লিভিংস্টনে, এক সেকেণ্ডের হাজার ভাগের ছ ভাগ পরে, অর্থাৎ আলোর যেটুকু সময় লাগে ওই দূরত্ব পাড়ি দিতে। সিগনালের তীব্রতা ও কম্পাঙ্কের নানা রকম হিসেব কষে বিজ্ঞানীরা বললেন, ব্ল্যাক হোল দুটোর ভরই সূর্যের চেয়ে অনেক বেশি, একটার প্রায় ৩৬ গুণ, অন্যটার ২৯ গুণ। এরা ছিলো পৃথিবী থেকে প্রায় ১২০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। মিলে গিয়ে নতুন যে ব্ল্যাক হোল তৈরি হল তার ভর সূর্যের প্রায় ৬২ গুণ। বাকি ৩ গুণ ভর তাহলে কি হল? এটাই বেরিয়ে গেছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আকারে, আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে, এক সেকেণ্ডের চেয়েও কম সময়ের মধ্যে, সুতরাং মহাবিস্ফোরণের মাত্রাটা সহজেই অনুমেয়।
এই প্রথম আমরা প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের, কাজেই উৎসাহের এবং উত্তেজনার কোনো কমতি নেই। কিন্তু এই তো সবে শুরু! ১৯১৬ সালের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রমাণ ১০০ বছর পরে পাওয়া খুশির ব্যাপার তো বটেই, কিন্তু নিউট্রন বাইনারির শক্তিক্ষয় দেখার পর এর অস্তিত্বে কারো সেরকম অবিশ্বাস ছিলো না। ইঞ্জিনিয়ারিং কোন পর্যায়ে উঠলে এরকম যন্ত্র বানানো যায় তা অবশ্য মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতন। আসল কথা হল যে আলোকতরঙ্গ ছাড়া মহাবিশ্বকে দেখবার আরো একটা জানলা খুলে গেল, এরপর নিশ্চয়ই আরও অনেক এরকম ঘটনা দেখা যাবে। আমেরিকার অন্যদিকে আরো একটা লাইগো যন্ত্র বসাতে পারলে আকাশের অন্যদিকটাও দেখা যাবে, তার জন্যে তৃতীয় লাইগো এদেশে বসানো হবে বলে এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এই তৃতীয় লাইগোর সংবেদিতাও অনেক বেশি হবে বলে শোনা যাচ্ছে, অর্থাৎ আরো দূরের আকাশের খবর পাওয়া যাবে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা লাইগোতে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, নিজেদের দেশে যন্ত্র বসলে আমাদের মহাকাশ গবেষণা যে এক ধাক্কায় অনেক এগিয়ে যাবে, এরকম আশা করাই যেতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পে অনুমোদন দিয়েছেন, এটা খুবই উৎসাহের খবর, বিশেষ করে মৌলিক গবেষণার দিগন্ত যখন আমাদের দেশে ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। তৃতীয় লাইগো বসবে মহারাষ্ট্রে – আশা করা যায় নরেন্দ্র দাভোলকরের রাজ্যে পুজো প্রার্থনা বা নারকেল ফাটিয়ে যন্ত্রের উদ্বোধন হবে না।