
বিগত ২০ বছর ধরে, তামিলনাড়ুর পুরাতত্ত্বিকরা অতীতের সন্ধান করে চলেছেন।মাটির নিচ থেকে প্রাপ্ত পুরনো লিপি প্রমাণ করে মানুষ অনেক আগেই লিখতে শিখেছিল। তারা এমন পথও খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে দিয়ে ভারত সমুদ্র পথে অন্য দেশে ব্যবসা করত। এছাড়া, পুরনো শহরের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন, যা থেকে প্রমাণিত হয় এখানে একসময় উন্নত শহর ছিল।এসব আবিষ্কার প্রমাণ করে তামিলনাডু একসময় বড় সভ্যতা ও ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল । সাম্প্রতিককালে গবেষকরা লোহার সবচেয়ে প্রাচীন ব্যবহার ও তৈরির প্রমাণ স্বরূপ আরও পুরনো জিনিস খুঁজে পেয়েছেন।এখনকার তুরস্কে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ সালে লোহা তোলা ও গলানো হতো বলে জানা যায়। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকরা তামিলনাডুর ছয়টি জায়গায় লোহার বস্তু পেয়েছেন, যেগুলি প্রায় ৫,০০০ থেকে ৫,৪০০ বছর পুরনো (খ্রিস্টপূর্ব ৩,৩৪৫-২,৯৫৩ )।এ থেকে বোঝা যায় ভারতে স্বাধীনভাবে লোহা সংগ্রহ, গলানো, গঠন ও বিভিন্ন জিনিস বানানোর প্দ্ধতি গড়ে উঠেছিল।আদিচ্চানাল্লুর, শিবগালাই, ময়ীলাড়ুমপরাই, কিলনামান্ডি, মাঙ্গাডু ও থেলুঙ্গানুরে পাওয়া নতুন আবিষ্কার স্থানীয় খবরের শিরোনামে এসেছে। মুলত এই সময়েই মানুষ লোহা ব্যবহার করে অস্ত্র, সরঞ্জাম ও অন্যান্য জিনিস তৈরি করতে শুরু করেছিল। অধ্যাপক পার্থ আর চৌহান জানান তামিলনাডুর এই আবিষ্কার প্রমাণিত হলে এটি বিশ্বের প্রাচীনতম প্রমাণগুলোর মধ্যে গণ্য হবে। প্রথম দিকে লোহা দুইভাবে পাওয়া যেত – উল্কাপিণ্ডের লোহা ও গলানো লোহা।খনিজ থেকে গলানো লোহা তৈরির পরই লোহার প্রকৃত ব্যবহার শুরু হয়।সবচেয়ে পুরনো লোহার জিনিস হলো উল্কাপিণ্ডের লোহা দিয়ে বানানো নয়টি ছোট মনিকা। লোহার পাথর খুঁজে বের করাই হল প্রথম সমস্যা।পাথর পাওয়া গেলে, তা উচ্চ তাপমাত্রায় চুল্লিতে গলিয়ে লোহা বের করতে হয়। না হলে লোহা পাথরের ভেতরই থেকে যায়।এরপর কারিগররা লোহা দিয়ে বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করেন। তামিলনাড়ুর বর্তমান গ্রামের কাছাকাছি প্রাচীন বসতি এলাকার বেশিরভাগ স্থানে লোহা পাওয়া গেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ কে. রাজন ও আর. শিবাননথাম জানান, ৩,০০০-এর বেশি লৌহযুগের কবরের মধ্যে এখনো পর্যন্ত মাত্র কিছুটা খোঁজা হয়েছে। এসব কবরের মধ্যে পাথরের কফিন ও লোহার নানা জিনিস রয়েছে। একটি জায়গায় খননে ৮৫টির বেশি লোহার জিনিস পাওয়া গেছে, যেমন ছুরি, তীরের মাথা, আংটি, ছেনি, কুঠার ও তলোয়ার ইত্যাদি। বিশ্বের পাঁচটি গবেষণাগারে ২০টির বেশি নমুনা পরীক্ষা করে প্রমাণিত হয়েছে এই জিনিসগুলি অনেক পুরনো।ইতিহাসবিদ ওসমুন্ড বোপরাচ্চি বলেন, একটি কবর থেকে পাওয়া লোহার তলোয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি শক্ত ইস্পাত দিয়ে তৈরি এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৩-১৫ শতকের সময়কার। উন্নত ইস্পাত তৈরিতে অনেক জ্ঞান ও উচ্চ তাপের দরকার হয়।গবেষকরা বলেন, তুরস্কে প্রথম ইস্পাত তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৩শ শতকে। কিন্তু তামিলনাডুতে তারও আগে লোহা তৈরি হয়েছিল।গবেষক ঐশী রায় বলেন, তামিলনাডুর মানুষ শুধু লোহা ব্যবহার করত না, নিজেরাই লোহা বানাত। কোডুমানাল নামে এক জায়গায় খননে একটি চুল্লি পাওয়া গেছে, যা উন্নত লোহা তৈরির প্রমাণ। বেশি তাপের কারণে চুল্লির জায়গা ধবধবে সাদা হয়ে গেছে।এছাড়াও কাছাকাছি লোহার বর্জ্য পাওয়া গেছে যার কিছুটা চুল্লির দেয়ালে লেগে ছিল।এ থেকে বোঝা যায় সেখানকার মানুষ নিজেরাই লোহা তৈরি ও গলানোর কাজ করত। তামিলনাডুর খননই প্রথম নয়, ভারতে এর আগেও লোহা পাওয়া গেছে।আটটি রাজ্যের ২৭টি জায়গায় ৪,২০০ বছর পুরনো লোহার প্রমাণ মিলেছে।প্রত্নতত্ত্ববিদ রাজন বলেন, তামিলনাডুর নতুন আবিষ্কার ভারতের লোহার ইতিহাসকে আরও ৪০০ বছর পিছিয়ে দিল। ঐশী রায় জানান, “লোহার যুগ এক জায়গায় শুরু হয়নি, বিভিন্ন জায়গায় আলাদাভাবে উন্নত হয়েছে। পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর ভারতেও লোহার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, তামিলনাডুর খনন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি লৌহ যুগ ও লোহা গলানোর ইতিহাস বদলে দিতে পারে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেন, তথ্যের পরিমাণ কম থাকার কারণে ভারতে আরও খননকার্য দরকার।বিশেষজ্ঞ কাত্রাগাড্ডা পাড্ডাইয়া বলেন, এটা তো শুধুমাত্র সূত্রপাত, গবেষকদের এবার লোহা তৈরির আসল উৎস খুঁজে বের করতে হবে।