শহরের নীলকণ্ঠ – ব্রাত্য যে জন

শহরের নীলকণ্ঠ – ব্রাত্য যে জন

অভিজিৎ চৌধুরী
Posted on ৯ জুলাই, ২০২২
সাফাইকর্মী

ছোটবেলায় একটি নাটক পড়েছিলাম । তার মূল প্রতিপাদ্য শহরের ভিতরে ম্যানহোল খুলে একটি তরুণ ছেলে ড্রেন পরিষ্কার করতে নেমেছে এবং তার সঙ্গী ওপরে প্রতীক্ষারত । বেশ কিছু সময়ের পরও তরুণ সাফাইকর্মীটি যখন ওপরে উঠে আসছে না, তাই দেখে উপরের ছেলেটি চিৎকার করে পথচারী মানুষদের কাছে সাহায্য চাইল তার বন্ধুটিকে তোলার জন্য । অনেকে থমকে দাঁড়ালো, অসহায় ছেলেটিকে কিছু জ্ঞান দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল । কয়েক ঘন্টা পর দমকল এল এবং ড্রেনের ভিতর থেকে তরুণ সাফাইকর্মীটির নীল হয়ে যাওয়া দেহটি উপরে তুলে আনল । হাইড্রেনের মধ্যেকার জমা বিষাক্ত গ্যাসে তার মৃত্যু হয়েছে । শিবঠাকুর বিষ পান করে অমৃত পেয়েছিলেন বেঁচে থাকার জন্য । শহরের নীলকন্ঠের জন্য কোন অমৃত মজুত নেই । মৃত্যুই তার অনিবার্য সত্য । এই ঘটনাটি নাটকের উপাদান হলেও বাস্তবে এই ধরনের ঘটনা প্রায়শঃই খবরের কাগজের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি ।

সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমস্ত রাজনৈতিক দলই ইস্তাহার প্রকাশ করেছে, যে ইস্তাহারে বিস্তৃতভাবে লেখা শহরকে সুন্দর করার পরিকল্পনা । রাজ্য সরকার “গ্রীন সিটি” প্রজেক্ট চালু করেছে শহরকে পরিবেশ বান্ধব বা পরিবেশ মিত্র করার জন্য । শহরকে পরিষ্কার রাখার অন্যতম শর্ত জঞ্জাল অপসারণ, তার সুষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও তৎসহ নিকাশি ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নতি বিধান । কিন্তু এই কাজটি করার প্রধান কুশীলব হলেন সাফাইকর্মীরা । সমস্ত শহরে সাফাই কর্মীরা মূলতঃ আসেন প্রান্তিক ঘর থেকে, যেখানে দারিদ্র্যই তাদের জীবনকে আবিষ্ট করে রেখেছে । আমরা যখন ভোরবেলায় বিছানায় শুয়ে থাকি সেই সময়ে সাফাইকর্মীরা রাস্তায় বেরিয়ে জঞ্জাল অপসারণ করেন । কারোরই হাতে নেই কোন গ্লাভস্ বা মুখে কোন আচ্ছাদন । যাঁরা নিকাশি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত তাঁরা খালি পায়ে ড্রেনের পাঁকে নেমে সেখান থেকে ময়লা তুলে নিকাশি ব্যবস্থাকে সচল রাখার চেষ্টা করেন । শহরের আবর্জনার দুর্গন্ধ তাঁরা টেনে নেন বুকের পাঁজরে কারণ এই কাজটি না করলে পেটের ভাত জুটবে না । এই সমস্ত সাফাইকর্মীর একটা বৃহৎ অংশ অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করে থাকেন এবং যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে তাঁদের এই কাজ করতে হয় । এঁরাই আমাদের সমাজের নীলকণ্ঠ ।

সমস্ত রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারগুলি পর্যালোচনা করলে যাবে সাফাইকর্মীদের পেশাগত দুরবস্থা দূর করতে বিশেষ কোন কথাই উচ্চারিত হয়নি কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যাঁরা ইস্তাহার তৈরি করেন তাঁদের কাছে এই সাফাইকর্মীরা ব্রাত্যজন । ওঁদের কষ্ট, ওঁদের যন্ত্রণা রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের স্পর্শ করে না । করোনা কালে সবাই যখন আতঙ্কিত তখনও নীলকণ্ঠ সাফাইকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন শহর পরিষ্কার রাখার তবু তাঁরা থেকে গেছেন আমাদের ভাবনার অলক্ষ্যে । আসন্ন পৌরনির্বাচনে এই নীলকণ্ঠদের নিয়ে কিছু কথা কি আমরা বলতে পারি না ? ভাবতে পারি না ? রবীন্দ্রনাথের কথায় এরা চিরকালই সভ্যতার পিলসুজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । শহরের সৌন্দর্য্য রক্ষার দায়িত্বে থাকা মানুষরা থেকে যান অবাঞ্ছিত এক জীবনের আবর্তে । শহরের অগ্রগতির অংশ হতে এঁরা কখনোই পারেন না । তাই চন্দননগরের লালদীঘির ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সৌন্দর্যায়ন হয় কিন্তু সাফাইকর্মীদের বাসস্থান থেকে যায় এক অত্যন্ত অবহেলিত পরিকাঠামোর মধ্যেই । কেবলমাত্র চন্দননগর নয়, যে কোন পৌর এলাকার সাফাইকর্মীদের বাসস্থানগুলিকে উন্নত করার কোন উদ্যোগ কখনোই চোখে পড়ে না । তাই নাগরিক সমাজকেই উদ্যোগ নিয়ে তুলে ধরতে হবে এঁদের দুর্ভাগ্যের কথা ।