শিকারীর ডাক ও তরুণ পাখির অভিবাসন

শিকারীর ডাক ও তরুণ পাখির অভিবাসন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৯ অক্টোবর, ২০২৫

শরতে, ইউরোপীয় রবিন প্রজাতির নবীন পাখিরা তাদের প্রথম দক্ষিণমুখী অভিবাসনে রওনা দেয়। যাত্রাটি বিপজ্জনক। পাখিরা প্রয়োজনমতো বিশ্রাম নিতে, শক্তি সঞ্চয় করতে ও চলাচলের সময় সুচিন্তিতভাবে নির্বাচন করে। কিন্তু অনেক সময় একটি অদৃশ্য শিকারীর ডাকই তাদের সিদ্ধান্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সম্প্রতি লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, নিশাচর শিকারীর ডাক শুনলেই নবীন পাখিরা তাদের শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস করে ফেলে। এমনকি তাদের অভিবাসন কৌশলেও পরিবর্তন ঘটে।

শিকারের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে প্রাণীদের আচরণ গড়ে ওঠে। এই ধারণাটি “ভয়ের ভূচিত্র ” নামে পরিচিত। রবিন প্রজাতির পাখির ক্ষেত্রে, শিকারীর ডাকই তাদের খাবার গ্রহণ, বিশ্রাম ও সক্রিয়তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। গবেষণায় তরুণ রবিনগুলিকে দুই ধরনের শিকারীর ডাক শোনানো হয়েছিল । ক. দিনের শিকারী স্প্যারো হক (sparrowhawk) এবং খ. নিশাচর টনি উল (tawny owl)। স্প্যারো হকের ডাক শোনার পরে পাখির সিদ্ধান্ত বা আচরণ উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়নি। কিন্তু টনি উলের ডাক শোনার পরেই পাখিরা খাবার খাওয়া কমায়। তাদের সক্রিয়তা কমে যায়। অভিবাসনের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয় করতে তারা ব্যর্থ হয়। এই প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে দেখায়, পাখিরা (বিশেষ করে অনভিজ্ঞ পাখিরা) খাদ্য গ্রহণ ও শিকারীর ঝুঁকি—এই দুইয়ের মধ্যে জটিল ভারসাম্য স্থাপন করতে গিয়ে ধন্দে পড়ে যায়। খাবার কম গ্রহণ করার ফলে সপ্তাহের শুরুতে শক্তি সঞ্চয় কম হয়। ফলে, অভিবাসন শুরুর সময় পাখিরা কম শক্তি নিয়েই রওনা দেয় এবং তাদের গড় যাত্রিক দূরত্ব কমে যায়। একাধিক বিরতির প্রয়োজন পড়ে, যা অভিবাসনকে দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।গবেষণাগারে দেখা গেছে, পাখিরা ক্রমাগতই সন্ধ্যার দিকে যাত্রা শুরুর চেষ্টা করছিল, কারণ তারা পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু টনি উলের ডাক শোনা পাখিরা সন্ধ্যার দিকে যাত্রা শুরুর সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেয়। ফলে যাত্রা শুরু করতে রাত গভীরে পৌঁছায়। এতে যাত্রার গতি হ্রাস পায়। অলক্ষ্য ভয় শুধু খাবারের সিদ্ধান্ত নয়, সময় ব্যবস্থাপনাকেও পরিবর্তিত করে। যদিও এই ভয়ের প্রতিক্রিয়া প্রথম কয়েক দিনেই বেশি দৃঢ় ছিল। গবেষণায় দেখা যায় শতভাগ নয়, দ্বিতীয় সপ্তাহে অনেক পাখি নিয়ন্ত্রণ গ্রুপের কাছাকাছি ফিরে আসে। অর্থাৎ এটি হয়তো একটি শ্রবণাতীত অবস্থা নয়, একটি অস্থায়ী উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া। তবুও, যাত্রার পথে কয়েক দিনের বিচলিত অবস্থা, খাবার কম খাওয়া এসব ছোট ছোট বিঘ্নই বড় প্রভাব ফেলতে পারে- বিশেষ করে সংক্ষিপ্ত সময়সীমার অভিবাসনে। অন্যদিকে, অভিজ্ঞ পাখিগুলো হয়তো পূর্ব অভিজ্ঞতার জোরে ঝুঁকি ও খাদ্য গ্রহণের মধ্যে একটি সমন্বিত আধার তৈরি করতে সক্ষম। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রশ্ন ওঠে: কিভাবে অভিজ্ঞতা, শারীরবৃত্ত, স্মৃতি ও পরিবেশগত সংকেত মিলিয়ে একটি পাখি তার অভিবাসন কৌশল গড়ে তোলে? অভিজ্ঞতাহীন পাখিরা কি ভয়কে জয় করতে শিখে নেয়? এই ফলাফল শুধুই তাত্ত্বিক গুরুত্ব বহন করে না। বাস্তব জীবনের সংরক্ষণমূলক পরিকল্পনায়ও এটি প্রভাব ফেলতে পারে। বিরতিস্থলগুলিকে শুধু খাওয়ার স্থান হিসেবে দেখা যায় না। সেগুলি এমন জায়গা, যেখানে ভয় এবং সুযোগের মধ্যে সমঝোতা ঘটে। যদি পাখি শান্তিপূর্ণ, অবিচ্ছিন্ন পরিবেশে বিশ্রাম নিতে পারে, তাহলে তারা সুযোগ নিয়ে বেশি খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে ও শক্তিশালী অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষানে আকেসন বলেছিলেন: “অভিবাসী পাখিরা বিভিন্ন ধরনের হুমকিতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেয়, তা বোঝার মাধ্যমে আমরা এমনভাবে বিরতিস্থল এবং নগর পরিবেশ পরিকল্পনা করতে পারি, যাতে তারা ভয়ে অবরুদ্ধ না হয়ে সুস্থ অবস্থায় যাত্রা চালিয়ে যেতে পারে।” তাহলে, অভিবাসন শুধুই শক্তি ও দূরত্বের লড়াই নয়। এটি অদৃশ্য শিকারীর ভয় ও শক্তির মধ্যে লড়াইও। একটি নিশাচর শিকারীর ডাকই তরুণ পাখির ভবিষ্যত গন্তব্য বদলে দিতে পারে।

 

 

সূত্র : Nocturnal but not diurnal threats shape stopover strategy in a migrating songbird by

Giuseppe Bianco, et.al ; British Ecological Society (First published: 23 May 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − eight =