
আপনি কি আপনার বিছানা গোছান সকালে ? আপনি মানুষ না হয়ে যদি শিম্পাঞ্জি হতেন, তাহলে সম্ভবত সন্ধ্যাবেলায় এই কাজটি করতেন। বাসা তৈরি বা বিছানা গোছানোর এই আচরণ, শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিদ্যমান। নিরাপদ বাসায় যথাযথ বিশ্রাম নেওয়া যায়। বাসা যত ভালো, ঘুম তত গভীর। ভালো বিশ্রাম তাদের শক্তি ও বুদ্ধি বাড়ায়। শিম্পাঞ্জিদের বাসা নির্মাণের মনোমুগ্ধকর প্রক্রিয়াটিকে বছর ধরে প্রাইমেট বিশেষজ্ঞরা পর্যবেক্ষণ করছেন। বিষয়টা খানিকটা দোলনা বানানোর মতো। এরা ডালপালাকে বৃত্তাকারে মোচড় দেয়, সেগুলিকে ছোট ছোট শাখা এবং পাতা দিয়ে শক্তিশালী করে। গাছের একেবারে মাথায় এই বাসাগুলি তৈরি করে। উদ্দেশ্য হল শিকারি প্রাণী এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া। রাতের বিশ্রামের বাইরেও, শিম্পাঞ্জিরা দিনের বেলায় অস্থায়ী বিশ্রামাগার তৈরি করে। একে অপরের লোম পরিষ্কার করার জন্য, একান্তে বসে একটু ঝিমিয়ে নেওয়া কিংবা চুরি করা ফল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে। যুবক শিম্পাঞ্জিরা তাদের বাসাগুলিকে খেলার জন্য ব্যবহার করে। ভেতরে এবং বাইরে উল্টে পাল্টে, সেগুলিকে জঙ্গল-জিমের মতো ব্যবহার করে। বড়রা আবার সেগুলিকে শান্তিতে পরিবেশ-পর্যবেক্ষণের জায়গা হিসাবে কাজে লাগায়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় একটি আকর্ষণীয় বিষয়ধারা উঠে এসেছে। যুবতী শিম্পাঞ্জিরা, পুরুষদের তুলনায় আগে এবং আরও ঘন ঘন বাসা তৈরি করে। আসলে অনেক কম বয়স থেকে এরা স্বাধীনতা চায়।
কানাডিয়ান প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ ইউলিয়া বাদেস্কু, বছরের পর বছর শিম্পাঞ্জিদের বাসা নির্মাণের আচরণ বোঝার জন্য, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল এবং আবার ২০১৮ সালে, কিবালের এনগোগো নামক একটি জায়গায় ৭২টি অপরিণত বন্য-শিম্পাঞ্জি পর্যবেক্ষণ করেন। আমেরিকান জার্নাল অফ প্রাইমেটোলজি-তে প্রকাশিত এই গবেষণাটি মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি সহযোগিতার ফসল। বাসা নির্মাণে বয়স, লিঙ্গ, এবং মাতৃত্বের অভিজ্ঞতার মতো বিষয়গুলিকেও তাঁরা বিশ্লেষণ করেছেন। আসলে বাসা তৈরি করতে, শারীরিক শক্তি এবং শেখার দক্ষতা উভয়ই প্রয়োজন। ডালপালাকে বাঁকানো এবং একটি স্থিতিশীল কাঠামোতে সেগুলিকে দোলনার আকারে বোনার ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে আসে না – এটি অভ্যাসের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। যুবক শিম্পাঞ্জিরা তাড়াতাড়ি বাসা নির্মাণের সাথে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেয়। তবে তারা যখন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখনই সম্পূর্ণভাবে এই কৌশলটি আয়ত্ত করে। বয়স্কদের তুলনায় যুবকেরা তুলনায় বেশি বাসা তৈরি করে এমনটাই ধারণা ছিল। কিন্তু সে জায়গায় উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল, যুবতী শিম্পাঞ্জিরা পুরুষদের তুলনায় আরও ঘন ঘন এবং আরও কম বয়সে বাসা নির্মাণে মনোযোগী হয়। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলিতেও দেখা গিয়েছিল মহিলা শিম্পাঞ্জিরা, পুরুষ সমকক্ষদের তুলনায় আগেই স্বাধীনতা চায় – এবং পায় । যুবক পুরুষদেরও বাসা নির্মাণ করতে দেখা যায়, তবে অত ঘন ঘন নয়। খুব ই লক্ষনীয় ব্যাপার হল, একবার একটি শিম্পাঞ্জি বাসা তৈরি করা শুরু করলে, তাদের এই পদ্ধতির একটা ধারাবাহিকতা থাকে এবং সেটা বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে। আসলে প্রয়োজনীয় দক্ষতার বিকাশ ঘটলে, যুবক শিম্পাঞ্জিরাও একই গতিতে তাদের বাসা নির্মাণ করে। স্ত্রী শিম্পাঞ্জিরা এই দক্ষতা রপ্ত করে অনেক আগেই। এই কাজ তাদের আত্মনির্ভরতার একটি সূচক। তবে, এটি কোনো জৈবিক অভিযোজন নাকি মায়েদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা, তা এখনও বলা কঠিন। বড় হবার সাথে সাথে বাসা তৈরিতে তাদের ভূমিকা পাল্টায়। যেমন চার বছরের নিচে শিশুরা বাসাগুলিকে খেলার জায়গা হিসাবে ব্যবহার করে। আবার বড় শিম্পাঞ্জিরা এগুলোকে আরও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করে। গবেষণাটি এই বাসাগুলিকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেছে। “পাথর দিয়ে আখরোট ভাঙ্গা বা লাঠি দিয়ে পিপঁড়ে ধরার মতো, বাসা তৈরি করা তাদের পরিবেশকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর একটি প্রক্রিয়া।” – জানিয়েছেন বাদুস্কি। গাছের ডালে নিরাপদে ঘুমানোর জায়গা তৈরি করার প্রবণতা আমাদের বিবর্তনীয় অতীতে গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে। শিম্পাঞ্জিদের ছোটবেলায় নিজের বিশ্রামের জায়গা তৈরি করার ক্ষমতা তাদের অভিযোজন এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার পরিচায়ক । অনেকেই ভাবেন, মানব শিশুদের মধ্যে একা একাই চারপাশের পরিবেশ আবিষ্কারের যে প্রাথমিক উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা – তার সাথে শিম্পাঞ্জিদের এই আচরণের অনেক মিল রয়েছে।