“আফ্রিকার রাজা, শশীবাবুর শিং আর আখতারির গান।”
শেষে জয়লাভ করলেও, ঘোষালবাড়ির গণেশমূর্তি উদ্ধারে এই তিনটি ব্যাপার রীতিমত খটকা জাগিয়েছিল প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের মনে। সবের মূলে অবশ্য ওই আফ্রিকার রাজা। বিচক্ষণ ক্যাপ্টেন স্পার্ক ‘তাঁর’ টাকরায় চ্যুইংগাম দিয়ে সূক্ষ্ম কাজটি না সারলে অবশ্য কি হত বলা যায় না।
তবে যাই হোক, আফ্রিকার রাজা যে কে তা বোধহয় সব বাঙালিই এতদিনে জানে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ পড়েনি বা নিদেনপক্ষে বড়পর্দায় দেখেনি – এরকম লোক মনে হয় কমই আছে।
আসলে মহালয়া আসতেই মনে হল, এই গল্পটার সাথে বাঙালির শারদীয় আবেগের একটা সংযোগ আছে। সেই চিন্তার স্রোতে ভাসতে ভাসতেই এক সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পুরাণ অনুযায়ী দেবী দুর্গার বাহন সিংহ। অর্থাৎ সেকালে লোকে সিংহ সম্বন্ধে অবগত ছিল! অথচ সিংহের উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা। তাহলে এদিকে এল কীভাবে! নিজের অজান্তেই মগজাস্ত্রটা হঠাৎ খুব সচল হয়ে উঠল।
আমার অনুসন্ধানের অ্যাসিস্ট্যান্ট শ্রী গুগল। বরাবরই তাই। এটা সেটা খুঁজতে খুঁজতে আচমকা একটা ‘হ্যাপি অ্যাক্সিডেন্ট’! গত শতাব্দীর আশির দশকের গোড়ায় বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ের দুটি গুহায় নাকি সিংহের জীবাশ্ম (fossil) খুঁজে পেয়েছিলেন পুরাতত্ত্ববিদরা। সেগুলির বয়স তখনই প্রায় ৫০,০০০ বছর। শুধু তাই নয়, জিরাফ ও স্পটেড হায়েনার জীবাশ্মও নাকি উদ্ধার হয়।
হাইলি সাসপিশাস! জিরাফ আর স্পটেড হায়েনা! ভারতে! তাও আবার খোদ বাঁকুড়ায়! ‘কাল্টিভেট’ করার তাগিদে ঝুলে পড়লাম কেসটা নিয়ে।
একের পর এক আশ্চর্য তথ্য বেরিয়ে আসতে লাগল।
সিংহের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে অন্য একটা ব্যাপার বুড়ি-ছুঁয়ে আসি। ‘সুপার-কন্টিনেন্ট থিয়োরি’ (Supercontinent Theory)। জটিল ব্যাপারটা সাদা বাংলায় বললে, পৃথিবীর স্থলভাগগুলি বড় বড় পাটাতনের মত মহাসাগরের জলে ভাসতে ভাসতে স্থান পরিবর্তন করে। তারা কখনো জুড়ে যায়, আবার কখনো ভেঙে যায়। ঠিক যেন একটা পেল্লায় জিগস পাজল। তবে এই ভাঙাগড়ার খেলা চলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। স্থলপিণ্ডগুলোর সমষ্টিকেই বলা হয় সুপার-কন্টিনেন্ট। প্যানজিয়া (Pangaea) হল এর সাম্প্রতিকতম ‘এডিশন’। প্যানজিয়া নির্মাণের পিছনে দায়ী ছিল দুটি ভূখণ্ড – গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড ও লরেশিয়া। প্রসঙ্গত, বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল প্রথমটির অন্তর্ভুক্ত। এবার এই দুইয়ে যখন ঠোক্কর খেল, সেই ২৫০ থেকে ২৬০ লক্ষ বছর আগে, তার থেকে তৈরি হল প্যানজিয়া। এর ফলে বর্তমান আফ্রিকা মহাদেশ আর বর্তমান এশিয়া মহাদেশের ভিতর একটা সেতুবন্ধন হল। (কন্টিনেন্টাল ড্রিফট থিয়োরি নিয়ে আজ আর বেশি বলব না।)
এই জুড়ে যাওয়া ভূখণ্ডের মাঝে কোন সাগরের চিহ্ন রইল না। অতঃপর জল ও খাবারের খোঁজে আফ্রিকার বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু পাততাড়ি গুটিয়ে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া শুরু করল। যারা ভারতবর্ষে প্রবেশ করল, প্রাথমিকভাবে তাদের বসতি ছিল হিমালয়ের শিবালিক পর্বতশ্রেণীর আশেপাশে।
কিন্তু এরপর এক থেকে দেড় লক্ষ বছর আগে, প্লেইস্টোসিন যুগে (Pleistocene period), সাইবেরিয়া থেকে উত্তর কাশ্মীরের ভূখণ্ড অবধি সাদা বরফের চাদরে ঢেকে যায়। শৈত্যপ্রবাহের দাপটে প্রাণীগুলি শিবালিক অঞ্চল ছেড়ে দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর নেমে আসে। আমাদের রাঢ় প্রদেশে ঘন বনরাজি ও অনুকূল আবহাওয়া পেয়ে তারা এখানেই বসবাস শুরু করে। এইভাবেই বাঁকুড়া হয়ে ওঠে এশীয় সিংহের (Asiatic lions) বিচরণভূমি।
তবে কালচক্রে জিরাফ ও হায়েনা অবলুপ্ত হয়ে যায়। সিংহও যা রয়ে গেছে, তা কেবল গুজরাটের গির জাতীয় উদ্যানে। সেটাও সম্ভব হয়েছে বিস্তর কষ্টসাপেক্ষ সংরক্ষণের ফলে।
তবে দেবী দুর্গার বাহনই হোক বা ক্যাপ্টেন স্পার্কের গুপ্ত কুঠুরিই হোক, সিঙ্গীমশাই অত বছর আগে এদিকে না এলে, সবই হয়ত অন্যরকম হত।
ছবি সৌজন্যঃ দ্য ফ্র্যাজাইল ফাইট