
৫০ কোটি বছর আগে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ, প্রজাতির বিবর্তনের পথে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিস্ফোরণের ফলে অনেক অদ্ভুত এবং জটিল জীবের জন্ম হয়। তার মধ্যে কিছু স্বল্পস্থায়ী জীবও ছিল। কোনো কারণ ছাড়াই এরা প্রায় রহস্যজনকভাবে একপ্রকার অদৃশ্য হয়ে যায়। তবে বিরল কিছু জীবাশ্ম চিরকালই বিজ্ঞানীদের তাদের প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এদের মধ্যে ছিল হেলমেটিয়া এক্সপেনসা। এটি একটি সন্ধিপদ প্রাণী। ১৯১৮ সালে চার্লস ডলিটল ওয়ালকট এটি আবিষ্কার করেছিলেন। শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এই হেলমেটিয়া রহস্য হিসাবেই রয়ে যায়। গবেষণাপত্রে এটির উল্লেখ থাকলেও, কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি। পরবর্তী গবেষণা এবং কোনো আধুনিক বিশ্লেষণ ছাড়াই, এতকাল হেলমেটিয়া কেম্ব্রিয়ান জীববিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় জীবাশ্মের নিছক একটি পাদটিকা হিসাবে রয়ে গিয়েছিল। ১০৭ বছর পর, একটি নতুন গবেষণা এই হেলমেটিয়াকে আবার জীবিত করে তুলেছে। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা লোসোর -এর নেতৃত্বে একটি গবেষণাদল এই অদ্ভুত প্রাণীর প্রথম সম্পূর্ণ বিবরণ দিতে পেরেছেন। ৩৬ টি নমুনার উপর ভিত্তি করে তারা কাজটি সম্পন্ন করেছেন । স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন এবং রয়েল অন্টারিও মিউজিয়াম, মূলত এই দুই সংগ্রহশালা থেকে এই নমুনাগুলিকে একত্রিত করা হয়। উচ্চ রেজলিউশন ফটোগ্রাফি, ক্রস পোলারাইজড আলো প্রভৃতি ব্যবহার করে হেলমেটিয়ার বহু তথ্য এঁরা আবিষ্কার করতে পেরেছেন। এটি সংরক্ষিত অন্ত্র, চোখ ,শুঁড় এমনকি হেলমেটিয়ার পেটের নীচে থাকা ছোট আরেকটি প্রাণী সম্পর্কেও নানা তথ্য দিয়েছে। “প্রজাতিটির সামগ্রিক রূপ পেতে আমাদের একাধিক নমুনাগুলিকে অধ্যয়ন করতে হয়”, লোসো বলেন। এটি বিশেষ করে চ্যাপ্টা নরম দেহের জীবাশ্ম। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে হেলমেটিয়ার দেহ ছিল প্রশস্ত পাতার মতন, ডিম্বাকৃতি। দৈর্ঘ্যে ৯২ থেকে ১৮৩ মিলিমিটার। দেহে ছটি বক্ষ-প্রকোষ্ঠ এবং বৃহৎ পাইজিডিয়াম ছিল। প্রতিটি পাঁজর, মেরুদণ্ডকে ঘিরে রাখত। জীবাশ্মে, বহি কঙ্কালের প্রান্তে সূক্ষ্ম দাগ দেখা যায়, যা এই ধরনের জীবাশ্মগুলিতে খুব কম পরিমাণেই সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে। প্রাণীটির মাথা থাকে সামনের দিকে । সেখান থেকে আবার লম্বা করে মেরুদন্ড বেরিয়ে গেছে। মাঝখানে গোলাকার একটি শক্ত প্লেট। তার নিচে দুটি বৃহৎ এবং মধ্যবর্তী চোখ। মাথার দুই পাশে ছোট গম্বুজের নিচে, দুটি পার্শ্ব-চোখ। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হেলমেটিয়াকে যেন একটি ভিনগ্রহীর চেহারা দেয়। প্রাণীটির অন্ত্র ছিল সরু নলাকার এবং পাঁচ জোড়া পাচনগ্রন্থি বিশিষ্ট। পাচনগ্রন্থগুলি আয়তকার এবং গঠনগতভাবে অত্যন্ত জটিল। এই অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলি, ক্যামব্রিয়ান সন্ধিপদ জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আরো গভীর করে তোলে। প্রাথমিক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল, এটি একটি ভাসমান প্রাণী, সম্ভবত সমুদ্রে ভেসে বেড়াতো, এর সম্পূর্ণ পা নেই। কিন্তু নতুন জীবাশ্ম বিশ্লেষণ অন্য কথা বলছে। বেশ কয়েকটি নমুনা থেকে ফুলকা এবং হাঁটার অঙ্গ উভয়ের অস্তিত্বই দেখা গেছে, যা শরীরের নিচে সরু খন্ডিত উপাঙ্গে অবস্থিত।
অঙ্গগুলি দ্বিখন্ডিত অবস্থায় ছিল। একটি খন্ড হাঁটা এবং আঁকড়ে ধরার জন্য পা হিসেবে কাজ করতো, অন্যটি ফুলকা হিসেবে। এই বিন্যাসটি অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক সন্ধিপদদেরই সদৃশ। হামাগুড়ি দিয়ে চলার জীবনধারাকেই এটি নির্দেশ করে। উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলির মধ্যে অন্যতম হল, হেলামেটিয়া ছিল দুই প্রজাতির মিশ্র প্রাণী। জীবাশ্মগুলিতে প্রাথমিক বহিঃকঙ্কালের নিচে একটি দ্বিতীয় ক্ষীণ রূপরেখা দেখা গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে প্রাণীগুলি পুরাতনটিকে ছিড়ে ফেলার আগে একটি নতুন ফোকর তৈরি করত। সমস্ত সন্ধিপদ তাদের শক্ত খোলস গলিয়ে ফেলে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এর সপক্ষে তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আধুনিক অশ্বক্ষুর বা হর্সশু কাঁকড়ার মতো হেলমেটিয়াও তার গলিত অংশ মাথা দিয়ে বার করে। এটি গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তনীয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। “এই সমস্ত নিদর্শন থেকে প্রাণীগুলি কিভাবে বেড়েছে শুধু তাই নয় বরং কতটা বাড়তে পারে তারও একটি আন্দাজ পাওয়া যায়,” লোসো বলেন। গবেষকদের বিশ্বাস, এই গ্রন্থিগুলি জটিল খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে সাহায্য করতো। মনে হয়, তারা সমুদ্রতলের জৈব ধ্বংসাবশেষ খেত। অন্ত্রগ্রন্থিগুলির অর্থোস্পিসিসের সাথে মিল থাকায় দুটি প্রজাতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ বিবর্তনীয় সম্পর্ক নিশ্চিত করে। উভয়কেই এখন একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পূর্ববর্তী গবেষণায়,
হেলমেটিয়াকে ট্রাইলোবাইডদের নিকটতম আত্মীয় মনে করা হলেও, এখন মনে করা হচ্ছে এটি আর্থোস্পিসের সবচেয়ে আদিম প্রজাতি কনসিলিটারগানদের কাঁটাযুক্ত দেহের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রজাতির অন্তর্গত। এটি হেলমেটয়েড প্রজাতির, অন্যদিকে টেগোপ্লেটেড গোষ্ঠীর মতন অমেরুদন্ডী। নমুনা থেকে আরেক ধরনের তথ্য পাওয়া যায- হেলমাটিয়া নতুন দেহখন্ড যোগ না করেই বৃদ্ধি পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক দশায় পৌঁছায়। হেলমাটিয়া, ক্যামব্রিয়ান সন্ধিপদদের বোঝার ক্ষেত্রে এক বিরাট অগ্রগতি। প্রাণীটির গঠন, বুদ্ধি, খাদ্য গ্রহণের উপরে এই গবেষণা আলোকপাত করে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এই গবেষণা, প্রায় ভুলতে বসা, কেবল জীবাশ্ম বিদ্যার পাতায় আটকে থাকা, একটি প্রজাতিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে।