
“আইসোস্ট্যাসি” শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ “আইসো-স্টাটিওস” থেকে, যার অর্থ “সম অবস্থান” বা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা। ভূ-ত্বকের বিভিন্ন অংশের , বিভিন্ন উচ্চতায় ভারসাম্য বজায় রেখে অবস্থান করাকে সমস্থিতি বা আইসোস্ট্যাসি বলে। আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদ ক্ল্যারেন্স ডাটন ১৮৮৯ সালে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন পৃথিবীর পৃষ্ঠের পাহাড় ও মালভূমি প্রভৃতি বিশাল উঁচু এলাকার ভারসাম্য বোঝাতে। এই তত্ত্ব অনুসারে, পৃথিবীর পৃষ্ঠে কম ঘনত্বের মহাদেশীয় ভূ-ত্বক (সিলিকন + অ্যালুমিনিয়াম = সিয়াল) ভেসে থাকে ভেতরের বেশি ঘনত্বের মহাসাগরীয় ভূ-ত্বক (সিলিকন + ম্যাগনেশিয়াম = সিমা) – এর উপর। মনে হয় যেন, পৃথিবীর পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্যগুলি একটি সমস্থিতিযুক্ত (আইসোস্ট্যাটিক) সামঞ্জস্যের সাথে অন্যের উপর বিশ্রাম নিচ্ছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে একাধিক ঘনত্বের স্তর রয়েছে। কেন্দ্রটি (core) সবচেয়ে ঘন এবং ভূপৃষ্ঠ সবচেয়ে হালকা পদার্থ। কেন্দ্রের ঘনত্ব ১৩.৫ গ্রাম/ঘন সেমি³, গুরুমন্ডলের ঘনত্ব ৩.৩ থেকে ৫.৭ গ্রাম/সেমি³ এবং মহাদেশীয় ভূ-ত্বকের ঘনত্ব প্রায় ২.৭ গ্রাম/ ঘন সেমি³।
প্লিস্টোসিন মহা তুষারযুগের পরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে সংঘটিত ‘হিমবাহ সমন্বয়’ ব্যাখ্যা করার জন্য সমস্থিতির (আইসোস্ট্যাসির) ধারণাটি অত্যন্ত কার্যকর। যেমন ফিনল্যান্ডের উত্থিত সমুদ্রতটগুলি থেকে দেখা যায় যে সমস্থিতিক সামঞ্জস্যের কারণে গত ৮০০০ বছরে প্রায় ২৫০ মিটার উত্থান ঘটেছে।
সমস্থিতির ধারণাটি প্রথম গড়ে ওঠে বিশাল পর্বতশ্রেণির অভিকর্ষীয় আকর্ষণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা থেকে। পিয়ের বুগের আন্দিজ পর্বতমালা (১৭৩৫-১৭৪৫) পরিমাপের সময় লক্ষ করেন যে চিম্বোরাজো পর্বতের অভিকর্ষ প্রত্যাশিত আকর্ষণের সঙ্গে মেলেনি, যেমনটি মেলা উচিত ছিল। এর ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন যে আন্দিজের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এই পর্বতগুলির কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভরের তুলনায় অনেক কম। ১৮৫৯ সালে ভারতের তৎকালীন সার্ভেয়ার জেনারেল স্যর জর্জ এভারেস্টের তত্ত্বাবধানে অক্ষাংশ নির্ধারণের জন্য সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমির ভূগাণিতিক জরিপের সময়ও অনুরূপ বৈষম্য লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কালিয়ানপুর ও কালিয়ানার (৩৭০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত) অক্ষাংশের পার্থক্য প্রত্যক্ষ ত্রিভুজাকার পদ্ধতি এবং জ্যোতির্বিদ্যা পদ্ধতি উভয় ভাবেই নির্ধারিত হয়েছিল। দুই পদ্ধতির ফলাফলের মধ্যে ৫.২৩৬ সেকেন্ড পার্থক্য পাওয়া যায়। অথচ কালিয়ানার অবস্থান হিমালয় থেকে মাত্র ৯৬ কিলোমিটার দক্ষিণে।
ত্রিভুজাকার পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল = 5 ° 23 ‘42.294″।
জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল = 5 ° 23’37.058″।
পার্থক্য= 5.236″
দুটি পদ্ধতির মধ্যে এই বৈষম্যর জন্য হিমালয়ের কম আকর্ষণকে দায়ী করা হয়েছিল। যে কারণে জ্যোতির্বিদ্যায় অক্ষাংশ নির্ধারণে ব্যবহৃত প্লাম্ব ববটি(সুতোয় ঝোলানো ভারী বস্তু) বিচ্যুত হয়েছিল।
বিভিন্ন ভূমিরূপের মধ্যে অভিকর্ষীয় আকর্ষণ-বিচ্যুতি এবং সমস্থিতিক ভারসাম্য ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন ভৌগোলিক ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন। ১৮৫৫ সালে স্যার জর্জ এইরি প্রথম তাঁর সমস্থিতিক মতবাদ উপস্থাপন করেন। এইরির তত্ত্বটি পদার্থের ভাসমানতার ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এইরি বলেন, পাহাড়ের ভেতরটা ফাঁপা হতে পারে না বরং তাদের অতিরিক্ত ওজন নীচের হালকা পদার্থ দ্বারা ভারসাম্য রক্ষা করে। অর্থাৎ হালকা স্তর ‘সিয়াল’ (মহাদেশীয় ভূ-ত্বক) ভাসছে ঘন স্তর ‘সিমা’-র (মহাসাগরীয় উপর। তিনি পাহাড়কে জলে ভেসে থাকা নৌকার সাথে তুলনা করেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি হিমশৈলের কথা বলেন। তিনি বলেন একটি বরফখণ্ড জলে ভাসলে, তার দশভাগের এক ভাগ জলের ওপরে থাকে এবং বাকি নয় ভাগ জলের তলায় নিমজ্জিত থাকে। এই ধারণা অনুসারে হিমালয়ের ৮৮৪৮ মিটার উপরে থাকার জন্য নীচে এর বাকি অংশ ৮-৯ গুণ অর্থাৎ ৭০,৭৮৪ থেকে ৭৯,৬৩২ মিটার গভীরে থাকতে হবে।
এইরির এই তত্ত্ব বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেললেও, তত্ত্বটি একেবারে ত্রুটিহীন নয়। সমস্যা হলো, ভূ-ত্বকের গভীরে প্রতি ৩০-৩২ মিটারে ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ৭০,৭৮৪ মিটার গভীরতার অনেক আগেই উষ্ণতা ও চাপ বৃদ্ধ্বির সাথে সাথে পদার্থটি গলে যাবে।তত্ত্বটি সমালোচিত হলেও এইরির মতকে সমর্থন করে হেইস্কানেন বলেন, গভীরতা বাড়ার সঙ্গে বস্তুর ঘনত্বও এমনভাবে বৃদ্ধ্বি পাবে যে উষ্ণতা ও চাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে পদার্থটি গলবে না।
পরবর্তীকালে, ১৮৫৯ সালে স্যার জর্জ এভারেস্ট ভারতবর্ষের জিওডেটিক সর্বেক্ষণের সময় কালিয়ানা (শিবালিকের ৯৬ কিমি. দক্ষিণে) এবং মালবে অবস্থিত কালিয়ানপুরের মধ্যে অভিকর্ষগত অসংগতি লক্ষ্য করেন। আর্কডিকন প্র্যাটের তত্ত্বাবধানে পর্বত, মালভূমি ও সমভূমির পদার্থের ওপর সমীক্ষা হয়। তিনি বলেন, উচ্চভূমির ঘনত্ব কম এবং নিম্নভূমির ঘনত্ব বেশি। যথা পাহাড়ের ঘনত্ব < মালভূমি < সমভূমি < সমুদ্রতল। তিনি প্রতিপূরণ তত্ত্বের (“Law of compensation”) ধারণা দেন। সে তত্ত্ব অনুসারে সকল স্তম্ভের ভরের ভারসাম্য রক্ষিত থাকে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, ভূমির স্তম্ভগুলো উচ্চতায় আলাদা হলেও তাদের ভর সমান, কারণ তাদের ঘনত্ব আলাদা। অর্থাৎ যার উচ্চতা যত বেশি তার ঘনত্ব তত কম এবং যার উচ্চতা যত কম তার ঘনত্ব তত বেশি । প্র্যাটের তত্ত্ব ‘ভাসমানতার সূত্র’ নয়, বরং ‘বিপরীত ঘনত্বের সূত্র’ অনুযায়ী কাজ করে। এটি শিলামন্ডলে ঘনত্বের ভিন্নতা মেনে চলে, কিন্তু গুরুমন্ডল ও কেন্দ্রমন্ডলে নয়। প্র্যাটের মতে, ভূ-ত্বকের গভীরে এমন এক প্রতিপূরণ তল রয়েছে , যার ওপরে পদার্থের ঘনত্বের পার্থক্য বোঝা যায়, কিন্তু যার গভীরে সে-পার্থক্য বোঝা যায় না। এই প্রতিপূরণ তলের ওপরে হালকা পদার্থ সমন্বিত সমভূমি কম উচ্চতায় অবস্থান করে। এইভাবে মহাদেশের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন উচ্চতায় সমতা বজায় রেখে অবস্থান করে।
অর্থাৎ, এইরি সম ঘনত্ব, ভিন্ন পুরুত্বের কথা বলেন। অপরদিকে প্র্যাট সম গভীরতা, ভিন্ন ঘনত্বের কথা বলেন। এই দুটি ধারণা পৃথিবীর ভূমিরূপ ও অভিকর্ষীয় বিচ্যুতির ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়। এছাড়াও, পরবর্তীকালে হেফর্ড, বাউই এবং জলি এই সমস্থিতি নিয়ে ভিন্ন তত্ত্ব দেন ।