
পৃথিবীর ৭১শতাংশ জল দ্বারা আবৃত ,যার ৯৭ শতাংশই মহাসাগরে রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে, ভূপৃষ্ঠের অধিকাংশ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সমুদ্রের নীচেও রয়েছে।এবার জানা যাক এই সমুদ্রতল কি? সমুদ্র তল হলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গভীরে সাগর বা মহাসাগরের তলদেশ, যেটি ব্যাসাল্ট শিলা দ্বারা গঠিত। সমগ্র বিশ্বে সমুদ্রতলের গঠন মূলত পাত সংস্থান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সমুদ্রতল অগভীর থেকে গভীরে কতগুলি ভূমিরূপ দ্বারা সজ্জিত। সেগুলি হল:
মহীসোপান অঞ্চল
মহীসোপান হল মহাদেশীয় ভূভাগের নিমজ্জিত অংশ যেখানে জলের গভীরতা সর্বোচ্চ ২০০ মিটার। অঞ্চলটি গড়ে ৬০ কিলোমিটার চওড়া। এটি সমুদ্রতলের অপেক্ষাকৃত অগভীর অংশ, এর ঢাল অতি মৃদু প্রায় ০.৫ ডিগ্রী। এই মহীসোপান অঞ্চল জীববৈচিত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রচুর সামুদ্রিক প্রাণী, শৈবাল ও উদ্ভিদের বাস। অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ভাবেও সমান গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখান থেকে তেল ,গ্যাস এবং খনিজ সম্পদ ব্যাপক হারে উত্তোলিত হয় । সমুদ্রের তলদেশের ৮% জুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলটি। পৃথিবীর ৯০% মাছ এই অঞ্চলেই পাওয়া যায়। সমুদ্রের দিকে মহীসোপানের সীমারেখা সেখানেই শেষ হয়ে যায়, যেখানে সমুদ্রের তলদেশ যথেষ্ট খাড়া অবস্থায় থাকে। এই অঞ্চলকে সোপান বিচ্যুতি বলা হয়।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে সাইবেরিয়ার উপকূলবর্তী মহীসোপান অঞ্চল ১৫০০ কিলোমিটার বিস্তৃত, যেখানে আফ্রিকার মহীসোপাননের বিস্তার মাত্র ১০ কিলোমিটার।
মহীঢাল- সোপান বিচ্যুতি থেকে সমুদ্রের দিকে গড়ে চার ডিগ্রী কোণে নত অবস্থায় খাড়া মহীঢালের অবস্থান । মহীসোপানের মতো মহাদেশ থেকেও ক্ষয়প্রাপ্ত প্রচুর বালি ও কাদা মহীঢালের পাদদেশেও জমা হয়। এসব সামুদ্রিক খাতের পার্শ্বদেশ খাড়া, প্রস্থচ্ছেদ V আকৃতি বিশিষ্ট এবং ভূ প্রাকৃতিক বন্ধুরতা ২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। কিছু কিছু অঞ্চলের ক্ষেত্রে অঞ্চলটি মারাত্মক খাড়া হতে পারে। যেমন কেপ অফ গুড হোপ-এর কাছে এটি মাত্র ১৬ কিলোমিটারে কুড়ি হাজার ফুট নেমে যায়।
মহীঢালের পলি সঞ্চয়ের ফলে সমুদ্রের অভ্যন্তরে বিশাল সামুদ্রিক খাত তৈরি হয়। বিভিন্ন পরিবহন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মহাদেশের প্রান্তভাগ থেকে গভীর মহাসাগর পর্যন্ত পলি পরিবহনের ক্ষেত্রে সামুদ্রিকখাত পরিবহন পথ হিসেবে কাজ করে।
মহাদেশের প্রান্তভাগের বাইরে অবস্থান করে গভীর মহাসাগর পর্যঙ্ক বা Deep ocean basins। এখানে সমভূমি থেকে শুরু করে সুউচ্চ ও খাড়া পার্শ্বদেশবিশিষ্ট পর্বত শৃঙ্গের মত বহু বিচিত্র ভূপ্রকৃতি দেখা যায়। যথা
পাতালিক সমভূমি
পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় এগুলি হলো সবচেয়ে সমতল অঞ্চল, যার আঞ্চলিক ঢাল প্রতি কিলোমিটারে এক মিটারেরও কম। এই পাতালিক সমভূমিগুলি প্রধানত স্থলভাগজাত। এগুলি তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার জলের গভীরতায় রয়েছে এবং ১০০ মিটার থেকে হাজার মিটারের অধিক পুরু ও জমাটবদ্ধ পলিস্তর দ্বারা গঠিত। এটি সমুদ্রতলের অর্ধেক অংশ জুড়ে বিস্তৃত। যেহেতু অঞ্চলটি সমুদ্রের গভীরে রয়েছে তাই এখানে সরাসরি সূর্যালোক পৌঁছাতে পারে না, ফলে এখানকার জীবদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক তথ্যই এখনো অজানা। আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে এই সমভূমিটি বিস্তৃত অংশ জুড়ে অবস্থিত(পৃথিবীর বৃহত্তম পাতালিক সমভূমি সোহম সমভূমি আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে অবস্থিত যেটি ৯০,০০০ বর্গ কিলোমিটার অবধি বিস্তৃত)। ভারত মহাসাগরের তলদেশেও এই সমভূমির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে এ ধরনের সমভূমি খুব কম অঞ্চল জুড়ে রয়েছে।
পাতালিক পাহাড়
এগুলি হল গম্বুজাকৃতি বা প্রলম্বিত পাহাড়। এগুলো হাজার মিটারের অধিক উঁচু নয় এবং ১০০ মিটার থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া। এদের বেশিরভাগই অগ্নুৎপাত জনিত শিলায় গঠিত এবং সূক্ষ্ম কণা বিশিষ্ট পলির একটি পাতলা স্তর দ্বারা আবৃত থাকে যা জলের মধ্যে দিয়ে থিতিয়ে পড়ে। এগুলো সমুদ্র তলের প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
সি মাউন্ট বা মৃত আগ্নেয়গিরি
শঙ্কুর মতো শৃঙ্গ ও খাড়া ঢাল বিশিষ্ট এই পাহাড়গুলি সমুদ্রতলদেশ থেকে এক হাজার মিটারের অধিক উঁচু হয়, কিন্তু সমুদ্রের জলতল পর্যন্ত পৌঁছায় না। সি মাউন্ট গুলি বিচ্ছিন্ন শৃঙ্গ হিসাবে অথবা দলবদ্ধভাবে গুচ্ছ হিসেবে থাকে। চ্যাপ্টা শীর্ষ বিশিষ্ট ছোট আকৃতির আগ্নেয় পর্বতগুলোকে গায়ট বলে। একসময় এরা সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ছিল কিন্তু তাদের শীর্ষগুলো তরঙ্গ ক্ষয়ের প্রভাবে চ্যাপ্টা ও সমতল হয়ে যায়। ডুবে যাওয়া এবং জলের নিচে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হওয়ার আগে এই আগ্নেয়গিরিগুলির অনেকখানি জায়গা জুড়েই প্রবাল দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছিল। অঞ্চলটি ভূতাত্ত্বিক এবং সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
গভীর সমুদ্রখাত
গভীর সমুদ্রখাত হল অপেক্ষাকৃত খাড়া পার্শ্ববিশিষ্ট, দীর্ঘ ও সংকীর্ণ অবনত ভূমি, যা চারপাশের তুলনায় তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার এর মতো বেশি গভীর।খাতগুলি মহাসাগরের অববাহিকার মধ্যভাগের কাছাকাছি কোথাও দেখা যায় না, বরং স্থলভাগের কাছাকাছি এদের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে মহাদেশের প্রান্তভাগ অথবা আগ্নেয় দ্বীপমালা বরাবর। এটি পৃথিবীর গভীরতম অঞ্চল। এখানেই অবস্থিত পৃথিবীর গভীরতম সামুদ্রিক খাত মারিয়ানা – যার গভীরতা ১১o৩৪ মিটার। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে অবস্থিত। এর গভীরতা পৃথিবীপৃষ্ঠের উচ্চতম অংশ মাউন্ট এভারেস্টের (৮৮৪৮মিটার) চেয়েও বেশি।
আগ্নেয় দ্বীপ
সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির অগনুৎপাতের ফলে এই দ্বীপগুলির সৃষ্টি হয়। এগুলি মূলত লাভা ও আগ্নেয় শিলা দ্বারা গঠিত, বা বলা ভালো আগ্নেয়গিরির ম্যাগমা লাভার রূপে বেরিয়ে এসে সমুদ্রের শীতল জলে ঠান্ডা হয়ে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই ধরনের দ্বীপের আকার নেয়। হাওয়াই ভলক্যানোস ন্যাশনাল পার্ক এর একটি উদাহরণ। এই দ্বীপগুলি সমুদ্রের তলদেশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। বর্তমানে এদের সংখ্যা পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। দ্বীপগুলি সাধারণত কিছুটা অস্থিতিশীল এবং বিশ্বব্যাপী সমুদ্রস্তর ওঠানামার ফলে লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যে নতুন দ্বীপ গুলি উন্মোচিত হয় আবার পুরনো গুলি ডুবে যায়।