
সমুদ্র মানেই কি উত্তাল ঢেউ, আর বিশাল গর্জন? বিজ্ঞান বলছে, সমুদ্রের আসল খেলা হচ্ছে ক্ষুদ্র কণিকার স্তরে। যেখানে গড়নপিটনের বদলে চলছে নিঃশব্দ শক্তিশালী নৃত্য। আর এই নতুন বোধের আবিষ্কারক SWOT (Surface Water Ocean & Topography) উপগ্রহ। এই মহাকাশের এই গুপ্তচর এখন ঠিক সেই জায়গাতেই নজর দিচ্ছে, যা এতদিন আমাদের নজরের বাইরে ছিল। মাত্র এক মাইল প্রশস্ত ‘সাবমেসোস্কেল এডি’ আর ‘মাইক্রো ওয়েভ’ নামের ক্ষুদ্র স্রোত ও ঘূর্ণির মধ্যেই লুকিয়ে আছে মহাসাগরের আসল খেলাঘর! শুনতে ছোট, কিন্তু কার্যকারিতায় বিশাল- সমুদ্রের গোপন শক্তিকেন্দ্র। SWOTএর চোখ দিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন কিভাবে সেইসব ক্ষুদ্র ঘূর্ণি নীরবে পরিবহন করে তাপ ও পুষ্টি, বদলে দেয় সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের চালচিত্র। আশ্চর্যজনকভাবে, অ্যাপোলো মিশনের মহাকাশচারীরাও মহাশূন্য থেকে এই ঘূর্ণিপথগুলিকে ফ্রেমে ধরেছিলেন, তবে ধরা পড়েছিল সামান্য কিছু ঝলক। আসলে, তখনকার উপগ্রহ বা জাহাজভিত্তিক যন্ত্রগুলির ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। SWOT সেই সীমাবদ্ধতাকে বিদায় জানিয়ে এখন বিশদ দ্বিমাত্রিক চিত্র তুলে আনছে। তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, জলের নীচে কতটা রমণীয় বিশৃঙ্খলা চলছে! সমুদ্র কোনও স্থির চিত্র নয়। এই উপগ্রহ শুধু ছবিই তোলে না। এ সমুদ্রের উচ্চতা মাপে, চাপ অনুভব করে, তরঙ্গের ঢাল খুঁজে বের করে। আর তখনই খেলা জমে ওঠে। সমুদ্র, কল্পনাতিরিক্ত গতিশীল। টেক্সাস A&M-এর সমুদ্রবিজ্ঞানী জিনবো ওয়াং বলছেন, “শক্তি না থাকলে সমুদ্র নিষ্প্রাণ। আর সেই শক্তির ছোট ছোট দানা ছড়িয়ে আছে ঘূর্ণি (এডি) আর তরঙ্গের মধ্যে।” SWOT দেখাচ্ছে, জাপান উপকূলে, কুরোশিও স্রোতের শাখায় একটি ওই ঘূর্ণির জল প্রতিদিন ২০ থেকে ৪৫ ফুট পর্যন্ত উল্লম্বভাবে উঠানামা করছে। আগে এটা ছিল কল্পনা, কিন্তু এখন বাস্তব তথ্য। দ্বিতীয় উদাহরণ, আন্দামান সাগরে ধরা পড়া একটি অভ্যন্তরীণ একক তরঙ্গ। শক্তির দিক থেকে এটি একটি সাধারণ অভ্যন্তরীণ জোয়ারের দ্বিগুণ। এ থেকে প্রমাণ হয়, এই তরঙ্গগুলো কোনোভাবেই “ছোট” নয়, তারা পর্বতসম শক্তিশালী। মডেল বদলাচ্ছে- বদলাচ্ছে ভাবনাও। গবেষক লি ফু বলছেন, “আমরা এতদিন ১০০ মাইল স্কেলে ভাবতাম। এখন আমাদের ১ মাইল স্কেলেও দেখতে হবে, SWOT আমাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছে।” নাসার ECCO মডেলের মতো সমুদ্রসঞ্চালন মঞ্চগুলো ইতিমধ্যেই এই নতুন তথ্য গ্রহণ করতে শুরু করেছে। এটি সময়সাপেক্ষ, কিন্তু একবার সবকটিকে একত্রীকরণ করা হলে, আমাদের ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ হবে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। সুতরাং মাইক্রো-স্রোত, সাবমেসোস্কেল ঢেউ, এই ক্ষুদ্র অথচ ব্যাপক শক্তির বিশ্লেষণ করতে পারলে জলবায়ু, বাস্তুতন্ত্র কিংবা ভবিষ্যতের পূর্বাভাসে বড় শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব হবে।