সরাসরি বাতাস থেকে ভিটামিন ও খনিজ টেনে নেওয়া

সরাসরি বাতাস থেকে ভিটামিন ও খনিজ টেনে নেওয়া

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিলে একটা অদ্ভুত আরামের অনুভূতি হয় না? সেটা কি শুধুই দূষণ-মুক্ত বায়ুসেবনের দরুন? তা না-ও হতে পারে।
পুষ্টির কথা ভাবলে আমাদের খাবার থেকে পাওয়া পুষ্টির কথাই মাথায় আসে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক লেখাপত্রের দিকে নজর দিলে এমন জোরালো প্রমাণ মিলবে যে মানুষ বাতাস থেকেও কিছু পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে। অ্যাডভান্সেস ইন নিউট্রিশন-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে যে পুষ্টি-উপাদান বাতাস থেকে সংগ্রহ করি তাকে বলা যেতে পারে বায়ব পুষ্টি-পদার্থ (এরোনিউট্রিয়েন্টস ) – যা অন্ত্রে শোষিত পুষ্টি-পদার্থ (গ্যাস্ট্রোনিউট্রিয়েন্টস) থেকে আলাদা। গবেষকদের প্রস্তাব, খাদ্য থেকে আহরিত পুষ্টির সম্পূরক হল শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শোষিত এই পুষ্টি, যেমন আয়োডিন, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ। এর সপক্ষে জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে।
বায়ব পুষ্টি-পদার্থগুলো আমাদের শরীরে নাক, ফুসফুস, গন্ধবিচারের আবরণী কলা (এপিথিলিয়াম) আর গলার পিছন দিককার অরো-ফ্যারিংক্সের রক্তবাহগুলোর একটা বর্তনী-জাল (নেটওয়ার্ক) মারফত শোষিত হয়ে ঢোকে। আমাদের ফুসফুস অন্ত্রের তুলনায় অনেক বড়ো অণু শোষণ করতে পারে – ঠিকমতো বলতে গেলে প্রায় ২৬০ গুণ বেশি বড়ো অণু। কোকেন, নিকোটিন আর কিছু কিছু অবেদনিক তো শোঁকবা-মাত্র দেহে ঢুকে পড়ে। এরা অতি অল্প মাত্রাতেই কাজ দেয়। যদি মুখ দিয়ে খেতে হত, তাহলে এত সামান্য পরিমাণ পদার্থ দিয়ে কাজ হত না।
এই অণুগুলো রক্তপ্রবাহে এবং মস্তিষ্কে অক্ষত অবস্থায় শোষিত হয়। কিন্তু অন্ত্রর ব্যাপারটা আলাদা। অন্ত্র পদার্থগুলোকে আগে উৎসেচক (এনজাইম) এবং অ্যাসিডের মাধ্যমে তাদের ক্ষুদ্রতম অংশে ভেঙে দেওয়ার পর তবেই সেগুলো আমাদের রক্তে প্রবেশ করে। এগুলি রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করলে পর তখন যকৃৎ (লিভার) দ্বারা এদের বিপাক এবং বিষ-শোধন (ডিটক্সিফাইড) হয়। স্টার্চ, শর্করা আর অ্যামিনো অ্যাসিড গ্রহণের ব্যাপারে অন্ত্রের জুড়ি নেই ঠিকই, কিন্তু অন্য কয়েক ধরনের ওষুধ গ্রহণের ব্যাপারে তা অতটা পটু নয়। বস্তুত, বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কীকরে মুখ দিয়ে খাওয়া ওষুধের কার্যকারিতা বাড়ানো যায়।
বায়ব পুষ্টি-পদার্থর কথা কিন্তু আজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন নয়। ১৯৬০-এর দশকের গবেষণাতেই দেখা গিয়েছিল লন্ড্রি-কর্মীরা আয়োডিনের সংস্পর্শে আসে এবং তাদের রক্ত এবং প্রস্রাবে আয়োডিনের মাত্রা বেশি থাকে। সম্প্রতিও এক গবেষণায় দেখা গেছে, আয়ারল্যান্ডের সামুদ্রিক শৈবাল-সমৃদ্ধ উপকূল এলাকায় বসবাসকারী কিছু স্কুলছাত্রর প্রস্রাবে অন্যদের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি আয়োডিন পাওয়া গেছে। গবেষকদের মতে উপকূল থেকে দূরে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী বাচ্চাদের তুলনায় এই শিশুদের মধ্যে আয়োডিনের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ শৈবাল-সমৃদ্ধ উপকূল এলাকায় বায়ুমণ্ডলে আয়োডিন গ্যাসের মাত্রা অনেক বেশি। অথচ দুই দল বাচ্চার খাবারের মধ্যে আয়োডিনের পরিমাণে কিন্তু কোনো পার্থক্য ছিল না। এই গবেষণা প্রমাণ করে, যেসব অঞ্চলে প্রচুর সামুদ্রিক শৈবাল আছে সেখানে বায়ুবাহিত আয়োডিন, খাদ্যতালিকাগত আয়োডিনের পরিপূরক হতে পারে। অর্থাৎ আয়োডিন একটি বায়ব পুষ্টি-পদার্থ যা আমাদের শরীরে শ্বাসের মাধ্যমেও প্রবেশ করে।
যেসব নিউরন নাকের গন্ধ গ্রহণ করে তাদের মাধ্যমে ম্যাঙ্গানিজ আর জিঙ্ক মস্তিষ্কে ঢুকতে পারে। ম্যাঙ্গানিজ একটি অপরিহার্য পুষ্টি-পদার্থ, কিন্তু তার মাত্রা অত্যধিক হলে এই রাসায়নিক মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে। যারা কারখানায় ঝালাইয়ের কাজ করে তারা বাতাসের উচ্চ মাত্রার ম্যাঙ্গানিজের সংস্পর্শে আসে, ফলে তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়। আমাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় এবং শ্বাসযন্ত্রে চুলের মতো সরু সরু কাঠামো বা সিলিয়ায় বিশেষ কিছু গ্রাহী (রিসেপ্টর) থাকে, যা অন্যান্য বায়ব পুষ্টি-পদার্থর সাথে সংযুক্ত হতে পারে; যথা কোলিন, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, এমনকি অ্যামিনো অ্যাসিড। সত্তর বছরেরও বেশি আগে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দেখা গিয়েছিল বায়ুতে প্রলম্বিত ভিটামিন বি১২-এর সূক্ষ্ম কণাস্রোত (এরোসোলাইজড) বর্ষণ করে আমাদের শরীরে ওই ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। যাদের শরীরে এই ভিটামিনের ঘাটতি রয়েছে তাদের পক্ষে এটি গুরুত্বপূর্ণ; যেমন কিছু নিরামিষাশী, প্রবীণ মানুষজন, ডায়াবেটিস রোগী এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল-পায়ী।
তবে এখনও আমাদের কাছে এ বিষয়ে অনেক তথ্যই অজানা। সবার আগে জানতে হবে সবুজ প্রান্তর, অরণ্য, সমুদ্র আর পাহাড়ি অঞ্চলের বায়ুর কোন কোন উপাদান স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। এখন পর্যন্ত গবেষণা হয়েছে মূলত অধিবিষ (টক্সিন), কণা-পদার্থ আর পরাগরেণু প্রভৃতি অ্যালার্জেন নিয়ে।
তারপর খুঁজে বার করতে হবে এর মধ্যে কোন কোন উপাদানকে বায়ব পুষ্টি-পদার্থ বলে চিহ্নিত করা যায়। বায়ুতে প্রলম্বিত ভিটামিন বি১২ –এর সূক্ষ্ম কণা বর্ষণ নিরাপদ এবং ফলপ্রদ, এটুকু আমাদের জানা আছে। এবার আরও গবেষণা চালিয়ে জানতে হবে ভিটামিন ডি প্রভৃতি অন্যান্য স্বল্প মাত্রার পুষ্টি-পদার্থকেও ওইভাবে ব্যবহার করা যায় কিনা। সেবনের মাত্রা (ডোজ), নিরাপত্তা এবং খাদ্যে অবদান নির্ধারণের জন্য আমাদের নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষায় এই বায়ব পুষ্টিপদার্থ নিয়ে আরও গবেষণা চালাতে হবে। ভবিষ্যতে হয়তো আমরা জানতে পারব বায়ব পুষ্টিপদার্থ কীভাবে নগরায়ন জনিত কিছু আধুনিক রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। হয়তো পুষ্টি-নির্দেশিকায় চিকিৎসকরা শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে পুষ্টি শোষণের সুপারিশও করবেন। হয়তো স্বাস্থ্যকর, সুষম খাদ্য খাওয়ার পাশাপাশি আমরা বায়ব পুষ্টিপদার্থ পাওয়ার জন্য প্রকৃতির কোলে শ্বাস নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করব।