সরীসৃপের প্রস্রাবে কেলাস নিঃসরণ 

সরীসৃপের প্রস্রাবে কেলাস নিঃসরণ 

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৬ নভেম্বর, ২০২৫

প্রকৃতিতে টিকে থাকার লড়াইয়ে সাপ ও অন্যান্য সরীসৃপ এক অনন্য রাসায়নিক কৌশল আবিষ্কার করেছে। তারা তরল মূত্র ত্যাগ করে না, একরাশ কঠিন, ঝকঝকে সাদা কেলাস জাতীয় পদার্থ নিঃসরণ করে। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই ‘কেলাস প্রস্রাব’ সরীসৃপদের বিবর্তিত জৈব বুদ্ধিমত্তার এক বিস্ময়কর উদাহরণ। মরু বা শুষ্ক অঞ্চলে বসবাসকারী প্রাণীদের কাছে জল টিকে থাকার চাবিকাঠি। মানুষ বা স্তন্যপায়ী প্রাণীরা মূত্রের মাধ্যমে তরল আকারে নাইট্রোজেন বর্জ্য বের করে দেয়। কিন্তু সাপ, টিকটিকি, গিরগিটি, কচ্ছপরা একেবারে ভিন্ন পথে হাঁটে। তারা দেহের নাইট্রোজেন বর্জ্যকে ইউরিক অ্যাসিডে পরিণত করে। আর সেটিকেই সাদা কেলাস আকারে শরীরের বাইরে বের করে দেয়। এভাবে তারা দেহের জলের অপচয়কে নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনে। গবেষকরা, বল পাইথনের মতো কিছু প্রজাতির বর্জ্যকে মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করেছেন। দেখা গেছে, প্রতিটি কেলাসের গঠন সূক্ষ্ম ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। এগুলির ব্যাস প্রায় ১ থেকে ১০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত। এই কেলাসের অভ্যন্তরে ইউরিক অ্যাসিডের সঙ্গে রয়েছে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের আয়ন বা লবণ, যা সরীসৃপদের শরীরে খনিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, এটি শুধু বর্জ্য ত্যাগ নয়। এটি দেহের খনিজ অবস্থারও এক সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা। বিজ্ঞানীরা বলছেন,“প্রত্যেকটি কেলাস যেন একেকটি ক্ষুদ্র রাসায়নিক কারখানা। সেখানে বর্জ্য, জল ও লবণ একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হয়”। সরীসৃপদের এই কেলাসযুক্ত মূত্র ব্যবস্থার আরেকটি গোপন উদ্দেশ্য হল, বিষ নিয়ন্ত্রণ। সাধারণত প্রাণীর দেহে নাইট্রোজেন বর্জ্য ভাঙতে গিয়ে তৈরি হয় অ্যামোনিয়া – যা একটি বিষাক্ত যৌগ। কিন্তু ইউরিক অ্যাসিডের এই কেলাস, অ্যামোনিয়াকে ‘অ্যামোনিয়াম ইউরেট’ নামক কঠিন রূপে বেঁধে রাখে। ফলে, দেহের কোষ – কলা বা আশেপাশের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। প্রকৃতির এ এক অনন্য আত্মরক্ষামূলক রাসায়নিক কৌশল। এই আবিষ্কারের সঙ্গে মানবদেহের সম্পর্কও গভীর। আমাদের শরীরেও ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই অ্যাসিড অতিরিক্ত পরিমাণে জমে গেলে তা গেঁটে বাতের বা কিডনির পাথরের কারণ হয়। কিন্তু সরীসৃপদের মতো আমরা ইউরিক অ্যাসিডকে দ্রুত কেলাসে পরিণত করে ফেলে দিতে পারি না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, “সরীসৃপদের এই প্রাকৃতিক কৌশল হয়তো একদিন আমাদের গাউট বা কিডনির পাথর প্রতিরোধে নতুন চিকিৎসার পথ খুলে দিতে পারে।“ মানুষের পূর্বপুরুষদের দেহে একসময় ছিল এক বিশেষ উৎসেচক ‘ইউরিকেস’। এটি ইউরিক অ্যাসিড ভেঙে ফেলতে পারত। কিন্তু বিবর্তনের পথে সেই জিনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সরীসৃপদের দেহে এখনও সেই রাসায়নিক বুদ্ধিমত্তার এক ভিন্ন সংস্করণ সক্রিয়, যা তাদের চরম পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। এই তুলনা আমাদের শেখায়, বিবর্তন শুধু দেহের নয়, রসায়নেরও ইতিহাস। এক ফোঁটা জল নষ্ট না করেই তারা শরীর থেকে বিষাক্ত নাইট্রোজেন বের করে দিচ্ছে। এ এমন এক জৈবপ্রযুক্তি যা মানুষের কাছেও অমূল্য শিক্ষা হতে পারে। প্রকৃতি যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়, বুদ্ধিমত্তা মানে শুধু মস্তিষ্কের বিকাশ নয়, জীবনের সঙ্গে রসায়নের সমন্বয়ও। তারই এক নিখুঁত, ঝকঝকে উদাহরণ সরীসৃপ প্রস্রাবে কেলাস নিঃসরণ।

 

সূত্র : Uric Acid Monohydrate Nanocrystals: An Adaptable Platform for Nitrogen and Salt Management in Reptiles by

Alyssa M. ThorntonTimothy; et.el; 22nd Oct, 2025; Journal of the American Chemical Society

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − 16 =