
দক্ষিণ মহাসাগর এক রহস্যময় স্থান। বরফ, কুয়াশা ও তীব্র বাতাসের আবরণে ঢাকা। নীলাভ সবুজ বর্ণের জলরাশিতে, যেন পৃথিবী নিজেই আকাশের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত দৃশ্য নিয়ে বিভ্রান্ত। উপগ্রহ ছবিতে ধরা এই উজ্জ্বল ফিরোজা রঙ নিয়ে। কারণ, এরকম প্রতিফলন সাধারণত দেখা যায় উষ্ণ জলে ভাসমান কোকোলিথোফোর নামের ক্ষুদ্র শৈবালের কারণে। এরা ক্যালসিয়াম কার্বনেটের চকচকে খোলস বানায়, যা সূর্যের আলো ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এই অঞ্চলটি বরফশীতল, কোকোলিথোফোরদের জন্য একেবারেই অনুকূল নয়। ২০০০ সালের শুরুর দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিগেলো মহাসাগর বিজ্ঞান গবেষাগার-এর গবেষকেরা অ্যান্টার্কটিকার চারপাশে একটি উজ্জ্বল পট্টি চিহ্নিত করেছিলেন- ‘মহা ক্যালসাইট বলয়’। যেখানে প্রচুর কোকোলিথোফোর এবং উচ্চমাত্রায় কণাকার অজৈব কার্বন ছিল। এটি সমুদ্র বা জলজ পরিবেশে ক্ষুদ্র কঠিন কণার আকারে অজৈব প্রলম্বিত কার্বন, যা সাধারণত ক্যালসিয়াম কার্বনেট যৌগের অংশ। এই ধরনের কার্বন মূলত আসে সামুদ্রিক জীব যেমন, কোকোলিথোফোর, ফোরামিনিফেরা বা প্রবালের খোলস ও কঙ্কাল থেকে। উপগ্রহ তথ্য নিশ্চিত করে যে ওই অঞ্চলের উজ্জ্বলতা এসেছে মূলত তাদের খোলস থেকেই। কিন্তু আরও দক্ষিণে দেখা যাচ্ছিল আরেকটি সমান উজ্জ্বল অঞ্চল। অথচ সেখানে কোকোলিথোফোরদের কোনো স্পষ্ট উপস্থিতি ছিল না। বরফ, ঢেউ এবং ঘন মেঘে আচ্ছন্ন থাকায় সরাসরি পর্যবেক্ষণ করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। সাম্প্রতিক এক অভিযানে, বিজ্ঞানীরা অবশেষেএর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন। এই উজ্জ্বলতার পেছনে থাকতে পারে একেবারে ভিন্ন ধরণের প্ল্যাঙ্কটন ডায়াটম। এরা সিলিকা দিয়ে তৈরি ঘন, প্রতিফলক কাঠামো গঠন করে। এই গঠন ডায়াটমকে সুরক্ষা দেয় এবং সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্র বা নকশা সহযোগে আলো ও পুষ্টি প্রবাহে সহায়তা করে। গবেষণার নেতৃত্ব দেন বার্নি বাল্চ। R/V Roger Revelle গবেষণা জাহাজে তারা হাওয়াই থেকে ৬০° দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। পথে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে থেমে জলের রঙ, ক্যালসিফিকেশন হার, আলোকসংশ্লেষ, অজৈব কার্বন ও সিলিকার ঘনত্ব পরিমাপ করেন। উপগ্রহ শুধু সমুদ্রের উপরের স্তরের কয়েক মিটার দেখে। কিন্তু তারা বহুমাত্রিক পরিমাপক নিয়ে সম্পূর্ণ জলস্তরের চিত্র তৈরি করেন, ঘূর্ণি প্রবাহের গতিপথও অনুসরণ করেন। গভীর স্তর থেকে পৃষ্ঠে জল তুলে আনে এই ঘূর্ণি স্রোত। পথে তারা ক্যালসিয়াম কার্বনেট ও সিলিকা উভয় খনিজের পরিমাণ মাপেন, যা কেবল আলো প্রতিফলনেই নয়, সমুদ্রের কার্বন সঞ্চয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, নিম্ন উষ্ণ মন্ডলীয় জলে প্রধানত ডাইনোফ্লাজেলেট আছে, যা একধরনের এককোষী অতিক্ষুদ্র অ্যালজি। ‘মহা ক্যালসাইট বলয়’ অঞ্চলে কোকোলিথোফোর প্রাধান্য পায় । কিন্তু পোলার ফ্রন্ট-এর দক্ষিণে, শীতল ও সিলিকা-সমৃদ্ধ জলে দাপট দেখায় ডায়াটম। গবেষকদের মতে, উপগ্রহে ধরা দক্ষিণের উজ্জ্বলতার চূড়ান্ত প্রমাণ হলো এই ফ্রাস্টল, যদিও কোকোলিথোফোর খোলসের মতো প্রতিফলন তৈরি করতে বেশি সংখ্যক ফ্রাস্টল লাগে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এই শীতল অঞ্চলেও পাওয়া গেছে কোকোলিথোফোর-এর উপস্থিতি, যদিও সংখ্যায় কম। কিন্তু এ থেকে বোঝা যায় তারা হয়তো পূর্বে যা ধারণা করা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি ঠান্ডা সহ্য করতে পারে। সম্ভবত এডি স্রোত তাদের উষ্ণ অঞ্চল থেকে এখানে পৌঁছে দিচ্ছে। দক্ষিণ মহাসাগর পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কার্বন আধার। এখানে কোন জীব কোথায় থাকে, উপগ্রহ চিত্রে তাদের কেমন দেখা যায়—এসব বোঝা জলবায়ু মডেল ও মহাসাগর পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির উন্নতি সাধনে অপরিহার্য। বর্তমানে উপগ্রহ অ্যালগরিদমে কোকোলিথোফোর ও ডায়াটমের পার্থক্য ধরা কঠিন। এর ফলে কার্বন প্রবাহের হিসাব ও সামুদ্রিক জীববিদ্যায় ভুল ব্যাখ্যা তৈরি হতে পারে। বার্নি বাল্চের ভাষায়, “আমরা কোকোলিথোফোর-এর বিস্তৃত অঞ্চল সম্পর্কে নতুন করে জানছি এবং উপগ্রহ চিত্রে দেখা রহস্যের পেছনের গল্পগুলো বুঝতে শুরু করছি। বহু পদ্ধতিতে পরিমাপ করলে যে পূর্ণাঙ্গ গহিনীটা জানা যায়, এ তারই প্রমাণ।”
সূত্র : Biological, Biogeochemical, Bio-Optical, and Physical Variability of the Southern Ocean Along 150°W and Its Relevance to the Great Calcite Belt by W. M. Balch, et.al ; Global Biogeochemical Cycles(Volume 39,Issue 8)(04 August, 2025)