বাংলাভাষায় বিজ্ঞান-রচনা: ভবিষ্যতের দিশা
(অধ্যাপক পলাশ বরণ পালের সঙ্গে কথা বলেছেন বিজ্ঞানভাষের প্রধান সম্পাদক ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরী। আজ পঞ্চম ও শেষ পর্ব)
ডাঃ চৌধুরী: আমার শেষ প্রশ্ন ।পলাশবাবু আপনার কাছে, আমরা জানি যে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার একটা ঐতিহ্য আছে। বহু মানুষ, উদ্যোগী মানুষ, বহু সংগঠন বহু দিন ধরে কাজ করে চলেছেন, এবং অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কিন্তু অনেকের মধ্যেই একটা ছটফটানি কাজ করছে, বা প্রতি মুহূর্তে কাজ করে, যে আরও বেশি মানুষের কাছে এই পত্রিকাগুলো বা এই খবরগুলো বা এই ভাবনাগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য নতুন যে কমিউনিকেশনের মাধ্যমগুলো আছে, অর্থাৎ কি না ডিজিটাল মিডিয়া, বা টেলিভিশন, বা পডকাস্ট, এইগুলোর কোনও ভূমিকা তো নিশ্চয়ই আছে, এইগুলোর সঙ্গে সাযুজ্য আনবার জন্য আমরা সবাই মিলে কীভাবে ভাবতে পারি? আপনার কী মনে হয়, এইগুলো কি সহায়ক হতে পারে? বা সহায়ক হতে গেলে কীভাবে এগোতে হবে, এই ধারাটাকে আরও একটু স্রোতস্বিনী করে তোলার জন্য? প্রতিটা ঘরের মধ্যে বিজ্ঞানের ভাবনা চিন্তাগুলোকে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। যেরকমভাবে মানুষ আপ্লুত হয়, মানুষ ভাসে খেলার খবর নিয়ে, কিন্তু মানুষ বিজ্ঞানের খবর নিয়ে ভাসে না। এইগুলো একও নয়। এক্ষুনি প্রশ্নটা আসবে; কিন্তু ছটফটানিটা হচ্ছে, এগুলোকে কী করে আরও বেশি বলশালী করা যায়। আপনার ভাবনাটা যদি বলেন।
অধ্যাপক পাল: এ বিষয়ে আমরা এখানে যে দু’জন আছি, তার মধ্যে আমার চেয়ে আপনার চিন্তা হয়তো অনেক বেশি, এবং আপনি হয়তো অনেক ভালো বলতে পারবেন, তাও আপনি যখন প্রশ্নটা করেছেন এড়িয়ে না যাওয়ার জন্য বলছি, এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে আমি হয়তো বেশি শিখতে পারি। যাই হোক, আমার মতামত হচ্ছে যে, নতুন অনেক রকম প্রযুক্তির মাধ্যম আসছে, সেগুলিকে ব্যবহার আমাদের করতেই হবে, কিন্তু সেগুলির ব্যবহার যে আমরা করছি না তা না, আমরা করছি। আপনি নিজেই যে বাংলা ‘বিজ্ঞানভাষ’ বার করেছেন এটাও তো সেইরকম এবং আপনার আগেও কিন্তু বাংলায় আন্তর্জালে বিজ্ঞান পত্রিকা বেরিয়েছে, এখনও বেরোচ্ছে। সেগুলোও তো প্রচেষ্টা, কাজেই প্রচেষ্টা যে হচ্ছে না তা নয়। আমার ধরুন বেশ কিছু বক্তৃতা পডকাস্ট করে ইউটিউবে দিয়েছি, আমার মতো আরও অন্য অনেকেই দিয়েছেন। এখন হচ্ছে বলে সন্তুষ্ট হয়ে থাকারও কোনও কারণ নেই, হচ্ছে না বলে বিমর্ষ হওয়া থাকারও কারণ নেই। যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে, আরও হতে হবে। এখন আরও হতে হওয়ার জন্য কয়েকটা যে— কী বলব পদক্ষেপ আমার মনে হয় জরুরি— সেগুলো সম্বন্ধে আমি যেরকম যা ভেবেছি একটুখানি বলি।
এক নম্বর যেটা আমি লক্ষ করেছি, সেটা হচ্ছে যে ধরুন বৈদ্যুতিন বই, যেটাকে আমি সংক্ষেপে বলি, বইবই, সেটা এখনও কিন্তু বাংলা ভাষায় পাওয়া যায় না। এটা বিজ্ঞানের না, বাংলা সাহিত্যও যদি হয়… মানে বাংলায় রবীন্দ্র রচনাবলী বৈদ্যুতিন সংস্করণ আছে, তিনখানা আছে, এটা বেশ গর্বের কথা। এটা ইংরেজি ভাষাতেও কোনও একজন বড় সাহিত্যিকের তিন প্রস্থ রচনাবলী আন্তর্জালে আছে, এর উদাহরণ খুব কম পাওয়া যাবে বলেই আমার বিশ্বাস, যদিও আমি সেরকমভাবে খুঁজে দেখার চেষ্টা করিনি হয়তো। কিন্তু যাই হোক, তিনটে যে আছে এটা বিরাট গর্বের কথা। কিন্তু এখন যে বই বেরোচ্ছে, ধরুন আমি আজকে যদি একটা বই লিখি, সেই বইটা এখনও কিন্তু সেই কাগজের ওপরে মুদ্রণ এই হিসেবেই বেরোবে। এখন সেই হিসেবেও বেরোক, আমিও চাই, কিন্তু তার সঙ্গে সেটা বৈদ্যুতিন বই হিসেবে তার একটা সংস্করণ থাকবে না, এ ব্যাপারে প্রকাশকদের আরও উদ্যোগী হওয়া উচিত, কিন্তু সেরকম উদ্যোগ আমি এখনও লক্ষ করিনি, খুবই দুঃখের সঙ্গে বলছি, ধরুন কামার অ্যামাজন কিন্ডলে একটা অ্যাকাউন্ট আছে, কিন্তু সেখানে বেশ কিছু বই সেখানে দেখেছি সেই বইগুলো যখন কিনতে যাই, তখন তারা নানান বিজ্ঞাপন দেখায়, তার মধ্যে বলে ভারতীয় ভাষার বই দ্যাখো, হিন্দু থাকে, তেলেগু থাকে, গুজরাটি থাকে, মালয়ালম থাকে, তামিল থাকে, বাংলা থাকে না। বাংলায় একটুও বই নেই সেখানে। এটা খুব দুঃখের কথা।
আচ্ছা এটা গেল এক নম্বর। দ্বিতীয় যে কথাটা আমার মনে হয়, সেটা হচ্ছে— অবশ্যই আমি যে কথাটা বলব, সেটা একেবারেই সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, কিছু ব্যতিক্রম আছেই এটা মেনেই নিয়েই আমি কথাটা বলছি; কথাটা হচ্ছে এই বাংলায় কেউ যখন বিজ্ঞান লেখেন, তখন তিনি বাংলায় বিজ্ঞান পড়ে বাংলায় লেখেন না। তিনি ইংরেজিতে পড়েন, বাংলায় লেখেন। এই ধরুন আপনার পত্রিকাতেই যাঁরা লিখছেন, তাঁদের নিয়ে একটা সমীক্ষা করতে পারেন, যে তাঁরা গত দু মাসে, বাংলায় কী লেখা পড়েছেন। মানে আপনার পত্রিকার অন্য লেখা পড়েছেন কি না, সেটা তাঁরা পড়ে থাকতে পারেন, মানে শুধু সংবাদ নয়, শুধু দু’মাসে না, এক বছরে কী পড়েছেন। মুশকিল হচ্ছে বাংলায় কিছু পড়েন না। বাংলা অস্পৃশ্য ভাষা, তাঁরা ইংরেজিতে পড়েন, বাংলায় লেখেন। দেখুন এই বোধটা মানসিক প্রতিবন্ধকতা বললাম তাই। আপনি যে কথাটা দিয়ে শুরু করলেন, যে বাংলায় বিজ্ঞান রচনার একটা বেশ বড় ঐতিহ্য আছে। এবং তাতে খুব ভালো ভালো লেখা হচ্ছে। আমি নাম করে একটাকে আর একটার ওপরে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করব না, তবে বহু ভালো ভালো বই আছে। আমি নিজে এই কথা বলতে পারি, আমি অনেক জায়গায় বলেওছি, অনেক জায়গায় লিখেওছি, যে আমি আজকে যে জায়গায় আছি, বিজ্ঞানী হয়েছি, তার একটা কারণ আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন আমাকে একটি বই স্কুল থেকে বার্ষিক পুরস্কার [হিসেবে] দেওয়া হয়েছিল, সেই বইটি পড়ে আমার এমন একটা উত্তেজনা হয়, যে আমি ঠিক করি যে বড় হয়ে বিজ্ঞানী হব। সেই বইটি বাংলায় ছিল। এগুলো তো গুরুত্ব অস্বীকার করার তো উপায় নেই। খুব আনন্দের সঙ্গেই বলি, আমি যখন সাহা ইনস্টিটিউটে ছিলাম, অন্তত দু-বার, এই ঘটনা ঘটেছে যে নতুন ছাত্রছাত্রীরা ভরতি হল, তাদের মধ্যে অন্তত একজন এসে আমার দরজায় ধাক্কা দিল।
স্যার, আসতে পারি?
এসো।
স্যার আপনিই কি পলাশ বরন পাল?
স্যার আপনাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিল, আপনার সঙ্গে কথা বলার আমার খুব ইচ্ছে ছিল।
কী কারণে?
স্যার আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি বা টেনে পড়ি, আপনার ‘কী দিয়ে সমস্ত কিছু গড়া’ বইটি আমি পড়েছিলাম আর সেইটা পড়েই আমার মনে হয়েছিল যে আমি এই বিষয়ে গবেষণা করতে চাই, সেইটার জন্যেই আমি আজকে এইখানে এসেছি। আমি তাদেরকে মুক্তকণ্ঠেই বলি যে এই তুমি কথাটা বললে এর থেকে বড় কোনও পুরস্কার আমি জীবনে কোনদিন পাব না, কোনদিন আশাও করি না। এইটা হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
এটা তো হয়। কাজেই যাঁরা বাংলায় লিখছেন, তাঁরা যদি অ্যা একটু বই পড়েন, আমি বলছি না যে সমস্ত বইই পড়তে হবে, সেটা কারও পক্ষেই সম্ভব না। কিন্তু বিচার করে পড়ুন। কোনটা পড়বেন, কোনটা না পড়বেন সেটা বিচার করুন, কিন্তু পড়ুন। এই দুটো ব্যাপারে আমার মনে হয় যে আমাদের একটু নজর দেওয়াটা উচিত। বাংলায় এমন অনেক— অনেক না হলেও দু-তিনটি প্রকাশন সংস্থা আছে যারা শুধু বিজ্ঞানের বই করেন। তাদের নতুন কী বেরোচ্ছে সেটার খোঁজখবর রাখুন। তারা যখন বিজ্ঞানের বই বার করে তখন তাদের একটা দায়বদ্ধতা তো আছেই। তাঁরা তো এই নিয়ে ভাবছেন। চারটে ইংরেজি পড়ে একটা বাংলায় লিখি। এই ব্যাপারটা একটু কমাতে পারলে হয়তো ভালো হয়। এইটুকু আমার বিনীত অনুরোধ।
ডাঃয়চৌধুরী: ধন্যবাদ, পলাশবাবু। আমরা প্রায় এক ঘণ্টা বাইশ মিনিট কথা বলেছি, এবং প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে দুজনেই কথা বলেছি। আমার মনে হয়, আপনি শেষে যে অসীম তৃপ্তির কথা বললেন, সেটাই আজকের মূল বার্তা হওয়া উচিত। এবং বিজ্ঞানের চর্চা যাঁরা করেন, বিজ্ঞান নিয়ে হইচই করা পছন্দ করেন, তাঁদের প্রত্যেকের জন্যেই আজকে আমাদের দুজনের কথা বলা। আমি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছি, আপনাকে প্রতি মুহূর্ত ইন্সটিগেট করে আমি বার করার চেষ্টা করলাম। আমার মনে হয় আমি সফল, নিজে কথা বলে আজকে সকালটাই ওই ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’-এর মতো শুরু হল। তো আবারও বলছি ধন্যবাদ ‘বিজ্ঞানভাষ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে।
অধ্যাপক পাল: আমার দিক থেকেও ধন্যবাদ দেওয়ার আছে আপনাকে, সেটাও আমি দিয়ে নিই, আপনি এত চমৎকারভাবে গোটা ব্যাপারটা সঞ্চালনা করেছেন, এটা আমার পক্ষেও খুব একটা বিরাট প্রাপ্তি। আরও একটা কথা বলে নিই, আপনি যখন শুরু করেছিলেন তখন আমাকে অধ্যাপক পাল বলছিলেন, শেষের দিকে আমাকে পলাশ বাবু বলছিলেন, আমি আশা করব এরপরে আমি যখন আমাদের দেখা হবে আপনি আমাকে পলাশদা বলবেন।
শিওর। ধন্যবাদ, নমস্কার।
………………………………
অনুলেখন ও সম্পাদনায় অর্পণ পাল।