সাধারণ অভ্যাস ও মস্তিষ্কের বয়স

সাধারণ অভ্যাস ও মস্তিষ্কের বয়স

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

বয়স বাড়লেও, সামান্য কিছু দৈনন্দিন অভ্যাস মেনে চললে মস্তিষ্কের বয়স বাড়ার গতি ধীর হয়। তার চেহারাও কম বয়সের দেখায়। এমনই দৃষ্টান্তমূলক এক নতুন গবেষণা প্রকাশ পেয়েছে। ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি‑র একটি দল অধ্যাপক কিম্বারলি টি-র নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণায় অংশ নিয়েছেন মধ্যবয়সী ও বয়স্ক নাগরিকেরা। এঁরা হাঁটুর আসন্ন রোগভয় অথবা পুরোনো হাঁটু‑অস্থিসন্ধি সংক্রান্ত সমস্যার ঝুঁকিতে ছিলেন। গবেষণাটি প্রায় দুই বছর ধরে চলেছে। এর মূল লক্ষ্য ছিল, সাধারণ দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক পরিবেশ ও অভ্যাস কিভাবে মস্তিষ্কের বয়স বাড়ার গতিকে প্রভাবিত করতে পারে, তা নির্ণয় করা। গবেষকরা প্রতিটি অংশগ্রহণকারীর এম আর আই স্ক্যান ব্যবহার করে মস্তিষ্কের ‘আনুমানিক বয়স’ নির্ধারণ করেছেন। তারপর সেটি ব্যক্তির সত্যিকারের বয়সের সাথে তুলনা করেছেন। মস্তিষ্কের বয়স ও বাস্তব বয়সের পার্থক্যকে বলা হয় মস্তিষ্ক বয়স ফারাক (‘ব্রেন এজ গ্যাপ’)। এ থেকে সম্পূর্ণ ‐মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের একটি সার্বিক চিত্র ফুটে ওঠে। এটি কোনো একক অংশের উপর নির্ভর করে না। স্ক্যান বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে একটি মেশিন‑লার্নিং মডেল, যার নাম ডিপ ব্রেইন নেট। এই মডেল ব্যবহার করে দেখা গেছে, ভালো অভ্যাস ও সামাজিক পরিপার্শ্ব, মস্তিষ্কের বয়স বাড়ার গতি কমায়। যারা বেশ কয়েকটি ভালো অভ্যাস মেনে চলছেন তাদের মস্তিষ্ক প্রায় আট বছর কম দেখায় শুরুতে। দুবছরের মধ্যে, তাদের মস্তিষ্কের বয়স বাড়ার গতি তুলনামূলকভাবে ধীর ছিল। অন্যদিকে আর্থ‑সামাজিক ঝুঁকি যেমন কম আয়, কম শিক্ষা ইত্যাদি কারণে যারা অতিরিক্ত ঝুঁকিতে ছিলেন, তাদের মস্তিষ্ক ‘ বেশি বয়সী দেখাচ্ছিল’ শুরুতেই। তবে সময়ের সাথে সাথে ঐ ঝুঁকিগুলি কিছুটা কম প্রভাব দেখিয়েছে। গবেষণায় কয়েকটি অভ্যাস ও পারিপার্শ্বিক বিষয় পাওয়া গেছে যেগুলোর ভূমিকা মস্তিষ্ক সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য। যেমন, ভালো ঘুম, নিয়মিত ঘুমোবার সময় ও ঘুমের পরিবেশ (যেমন অন্ধকার, নিম্ন তাপমাত্রা) মস্তিষ্কের জন্য বিশেষ সুরক্ষা দেয়। ঘুম কম হওয়া বা বিঘ্নিত হওয়া মস্তিষ্কে স্ট্রেসের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এটি স্মৃতি ও মনোভাবকে প্রভাবিত করে। স্বাভাবিক বা কম উত্তেজনা, মন শান্ত রাখা, চিন্তা ও উদ্বেগ কমিয়ে আনা প্রতিদিনের অভ্যাসের মাধ্যমে স্ট্রেস রেসপন্স কম হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব কমিয়ে দেয়। ইতিবাচক মনোভাব ঘুম ও স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। যারা বেশি আশাবাদী, তারা স্ট্রেস কম অনুভব করে ও তাদের ঘুমের গুণমান বাড়ে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু, সম্প্রদায় যারা পাশে থাকে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা শুধু মানসিক স্বস্তির কারণ নয়, এতে আয়ুও বাড়ে। গবেষণাটি পর্যবেক্ষণমূলক। অর্থাৎ, এটি কোনো বিশেষ অভ্যাসের কারণে সরাসরি মস্তিস্কর বয়স কমেছে বা বাড়িয়েছে এমন কোনো প্রমাণ দেয় না। তবে অভ্যাস ও মস্তিষ্কের বয়স বাড়ার গতির মধ্যে স্পষ্ট সম্পর্ক পাওয়া গেছে। তাছাড়া অংশগ্রহণকারীদের দলটি নির্দিষ্ট ছিল- যারা হাঁটুর সমস্যায় ভুগছেন বা এর ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাই ফলাফল সব ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য হবে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য বৃহত্তর ও বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার উপর গবেষণা করা দরকার। গবেষকদল ভালো ঘুম, স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সংযোগ ও ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। যেমন নিয়মিত ঘুমের সময় নির্ধারণ ও ঘুমের ঘুমরাতের পরিবেশ যতটা সম্ভব অন্ধকার ও শান্ত রাখা। ঘুমে বিঘ্ন থাকলে, সেক্ষেত্রে কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপির সাহায্য নেওয়া। দৈনন্দিন জীবনে ছোট‑ছোট অনুশীলন যেমন ধ্যান, শ্বাস‑প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ, মনঃসংযোগ বাড়ানোর মতন কাজ করে স্ট্রেস কমানো। সামাজিক বন্ধন দৃঢ় রাখা—সাহায্য চাওয়া ও দেওয়া, মানুষে ‑মানুষে যোগাযোগ বজায় রাখা ইত্যাদি। গবেষণাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যে মস্তিষ্কের “বয়স” সরাসরি সময়ের উপর নির্ভরশীল নয়। তা অনেকবেশী করে আমাদের জীবনধারা, মনোভাব ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা মিলে নির্ধারিত হয়। ছোট‑ছোট ইতিবাচক অভ্যাসের ধারা বজায় রাখলে মস্তিষ্কের বয়স বাড়ার গতি ধীর করা সম্ভব। তাতে আমাদের মানসিক ও শারীরিক দুই সুস্থতাই লাভবান হতে পারে।

 

সূত্র : More than chronic pain: behavioural and psychosocial protective factors predict lower brain age in adults with/at risk of knee osteoarthritis over two years by Jared J Tanner, Brain Communications, Volume 7, Issue 5, 2025, fcaf344, Published: 11 September 2025

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 − two =