
‘ইখথিওসর’ এক প্রকার বিলুপ্ত সামুদ্রিক ‘মাছ সদৃশ’ সরীসৃপ। এরকমই এক ইখথিওসর ‘ফিওনা’ র জীবাশ্ম সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক মহলের বাইরেও কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ সালে, প্যাটাগোনিয়ার এক হিমবাহ ক্ষেত্র খনন করে, ফিওনাকে পাঁচটি অংশে অতি যত্নে উদ্ধার করা হয়। ম্যাগালোনস বিশ্ববিদ্যালয় এবং চিলির কেপ হর্ন আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের প্রধান গবেষক জুডিত পারদো পেরেজ একটি বৃহৎ দলের সাথে কাজ করে জীবাশ্মটি প্রাকৃতিক ইতিহাস সংগ্রহশালা ‘রিও সেকো’-তে স্থানান্তর করেন। জীবদ্দশায় এর উচ্চতা ছিল প্রায় ১১ ফুট। তবে তার লম্বা নাকটি বালিতে কয়েক ইঞ্চি ডুবে যাওয়ার ফলে কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফিওনার হাড় গুলি, প্রাথমিক ক্রিটেসিয়াস যুগের সামুদ্রিক সরীসৃপের জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। এই বিষয়ে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য যথেষ্ট ছিল না। তাই ফিওনার সম্পূর্ণ কঙ্কালটি, এক্ষেত্রে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, এরা সেই সময়ের শীর্ষ সামুদ্রিক শিকারী ছিল। বিভিন্ন অক্ষাংশ থেকে প্রাপ্ত এই প্রাণীর বিস্তৃত বিবরণ ইঙ্গিত দেয় যে, তারা বিভিন্ন পরিবেশগত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। তবে, চিলিতে পাওয়া একমাত্র সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষিত খননকৃত গর্ভবতী ইখথিওসর হল ফিওনা। তার শরীরের ভিতরে জীবাশ্মকৃত মাছের হাড়ের টুকরো ছিল, যাতে স্পষ্ট হয় তার খাওয়া শেষ খাবারটি সে হজম করতে পারেনি। তার ভ্রুণটিও বেশিরভাগটাই অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। জন্মের জন্য সে প্রায় প্রস্তুত ছিল। ভ্রুণের লেজটি মায়ের দেহ থেকে বেরিয়ে আসছে- তা থেকেই এমন আন্দাজ। মা এবং ভ্রুণ উভয়ের কঙ্কালের বৈশিষ্ট্য, সেই সময়কালের সামুদ্রিক সরীসৃপের মধ্যে খুবই কম দেখা যায়। বলা যায়, এটি প্যালিওপ্যাথোলজির দিকগুলিকেও প্রকাশ করে।
সম্পূর্ণ জীবাশ্মটি হঠাৎ করে সমাহিত হওয়া এক গল্প বলে যেন! বিজ্ঞানীদের মনে হয় জলের নীচে ভূমিধসের প্রবল বালির স্রোত ফিওনাকে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে ঢেকে ফেলে। এইভাবে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু মা এবং অনাগত শিশু সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ সুবিধা দেয়। “বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত আমাদের এই গবেষণা এখন খুবই সমন্বয়মূলক”, বলেছেন ম্যাট মালকোস্কি, যিনি হলেন অস্টিন জাকশন স্কুল অফ জিও সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক । মালকোস্কি কিন্তু প্রথম থেকেই ফিওনা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। জেল পেইন জাতীয় উদ্যানে পারদো পেজের সাথে তার দেখা হওয়ার পরে তিনি এই প্রকল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিছু ভূতাত্ত্বিক লক্ষণ দেখে, তারা উভয়েই বুঝতে পারেন এই অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে একাধিক ভূমিধস হয়েছে। এই একই হিমবাহের নীচে ৮০টির বেশি ইখথিওসর সমাহিত ছিল। মালকোস্কি জানান, জলবায়ু, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, মহাদেশগুলির মধ্যে সংকীর্ণ মহাসাগরীয় পথ খুলে যায়। “বড় শিকারি হওয়ায়, অভিবাসনের পথের ব্যাপারে শিকারিরা অনেক যত্নশীল থাকে। মাছ ধরা কিংবা শিকার ধরা, সর্বোপরি নিজের কাজ সহজে করতে পারা এই বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার সাথে সাথেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় বংশবৃদ্ধি করার উপযোগী আবাসস্থল”। ঠিক এই কারণগুলির জন্যই দক্ষিণ আমেরিকায় ফিওনা ধ্বংসাবশেষ মেলে। ভূদৃশ্যের পরিবর্তনের ফলে বর্তমান দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে সামুদ্রিক জীবন প্রভাবিত হতে পারে। পারদো পেরেজ জানান, উন্নত ইমেজিং পদ্ধতিগুলি তার অনন্য কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যগুলিকে উন্মোচন করতে সাহায্য করবে। প্রাপ্তবয়স্ক ইখথিওসরের স্বাভাবিক খাদ্যাভাস, উন্নত গর্ভাবস্থা এবং উন্নত হাড়ের প্রমাণ দেয় ফিওনা। অপরদিকে মালকোস্কির পাললিক কৌশলগুলি থেকে প্রকাশ পায়, সেখানে বারবার কোন ঘটনা ঘটে বিভিন্ন স্তরের জীবাশ্মগুলি ছড়িয়ে পড়ে নাকি একটি বৃহত্তর বিপর্যয় ঘটেছিল। এই জ্ঞান সুদূর অতীতে সমুদ্র অববাহিকা কিভাবে বিবর্তিত হয়েছিল তার একটি বিস্তৃত চিত্র আঁকতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, এ থেকে চারপাশের শিলা থেকে পাওয়া খনিজ পদার্থের ওঠা-নামা দেখা যেতে পারে, প্রাচীন সমুদ্রগুলি কিভাবে টেকটনিক রূপান্তরনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল এবং জলে থাকা শিকারিদের প্রভাবিত করেছিল তাও বোঝা যেতে পারে। দক্ষিণ অক্ষাংশে ইখথিওসর জনসংখ্যাকে বিজ্ঞানীরা কিভাবে দেখবেন সে বিষয়ে ফিওনা এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। প্যাটাগোনিয়ায় ভবিষ্যত খননের ক্ষেত্রে এই আবিষ্কারের কি প্রভাব পড়বে তাই নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অত্যন্ত কৌতূহলী। সেই সময়ের স্থানীয় জলবায়ুর পরিস্থিতি বোঝার জন্য তার দেহাবশেষের চারপাশের নমুনা সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এটি, একাধিক সমাধিপর্বের অন্তর্নিহিত কারণগুলিকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়। বিলুপ্ত প্রজাতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করার জন্য ‘ফিওনা’ এক বিস্ময়!