সুলভে আবহাওয়ার পূর্বাভাস

সুলভে আবহাওয়ার পূর্বাভাস

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ মার্চ, ২০২৫

কয়েকদিন আগে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, নতুন প্রযুক্তি এসে এবার আবহাওয়ার পূর্বাভাস দানের পদ্ধতি আমূল বদলে দিতে চলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকশিত ‘আর্ডভার্ক ওয়েদার’ নামের এই নতুন পদ্ধতি আবহাওয়ার নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে পারছে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আর এর জন্য যেকোনো সাধারণ ডেস্কটপ কম্পিউটারই যথেষ্ট। অ্যালান টুরিং ইন্সটিটিউট, মাইক্রোসফট রিসার্চ আবং ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেন্‌জ ওয়েদার ফোরকাস্ট, এই তিন সংস্থাও এই গবেষণায় সাথী হয়েছে। বর্তমানে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য বিশাল বিশাল সুপার কম্পিউটার লাগে। তাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে, একের পর এক প্রকৌশল-ধাপ পেরোতে হয়। খরচও হয় বিস্তর। অল্পকাল আগে কয়েকটি কম্পানি দেখিয়ে দিয়েছে যে এইসব ধাপের মধ্যে অন্তত একটি ধাপকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পাশ কাটানো সম্ভব। এর ফলে এরই মধ্যে অনেক দ্রুত আরও নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু নতুন এই আর্ডভার্ক মডেল আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এতে একটাই মাত্র মেশিন লার্নিং মডেল ব্যবহার করে একের পর এক সবকটি প্রয়োজনীয় ধাপ অতিক্রম করা যাচ্ছে। উপগ্রহ, সেন্সর আর আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে টাটকা উপাত্ত (ডেটা) নিয়ে তৎক্ষণাৎ তা থেকে স্থানীয় এবং সর্বাঙ্গীণ পূর্বাভাস জানিয়ে দিতে পারছে এই মডেল। ফলত বিদ্যুৎগতিতে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব দেওয়া হচ্ছে ডেস্কটপ কম্পিউটার থেকেই। আর যেহেতু এই মডেলকে সরাসরি ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তাই একেবারে শূন্য থেকে পূর্বাভাস দানের জন্য তৈরি করা সিস্টেমে যেসব প্রতিবন্ধক থাকে সেগুলি এই মডেলকে বিব্রত করে না। অ্যালান টুরিং ইন্সটিটিউটের এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রিচার্ড টার্নার এই প্রকল্পের মুখ্য গবেষক। দেখা গেছে, প্রচলিত মডেলগুলোর তুলনায় মাত্র ১০% ডেটা ব্যবহার করেও এই নতুন মডেল আমেরিকার জাতীয় জিটিএস মডেলের চেয়ে ভালো কাজ করে। এটি শুধু যে দ্রুতগতিতে কাজ করে তাই নয়, এর বহুমুখী পারদর্শিতাও অতুলনীয়। কোনো বিশেষ অঞ্চলের বৃষ্টিপাত কিংবা হাওয়ার গতি প্রভৃতির স্থানীয় পূর্বাভাস দেওয়ার কাজেও একে চট করে প্রশিক্ষিত করে নেওয়া যায়। আগে যে-কাজ করতে বছরের পর বছর সময় লাগত, এখন তাতে লাগবে কয়েক সপ্তাহ। এর নিরবচ্ছিন্ন (এন্ড টু এন্ড) শিক্ষাগ্রহণের পরিমার্গকে হারিকেন, দাবানল, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতির পূর্বাভাস দেওয়ার কাজেও লাগানো যাবে। শুধু আবহাওয়া কেন, বৃহত্তর পার্থিব সিস্টেমের অনেক কিছুরই পূর্বাভাস দেওয়ার কাজে এ-কে লাগানো যবে, যথা বায়ুর গুণমান, সামুদ্রিক গতিশীলতা, সমুদ্রে বরফ জমা। তবে এর সবচেয়ে আগ্রহজনক বৈশিষ্ট্য হল সুসাধ্যতা। প্রাচণ্ড দামি সুপারকম্পিউটারের ওপর নির্ভরশীল নয় বলে এ-কে যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করা যাবে, এমনকি যেসব দেশে কম্পিউটার ব্যবস্থা উন্নত নয় সেসব দেশেও। আর্ডভার্ক বিভিন্ন দেশের গবেষক সম্প্রদায়ের যৌথ সক্রিয়তা কীভাবে এ আই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত ও অর্থবহ করে তুলতে পারে তারও উদাহরণ। পরের পর্যায়ে আর্ডভার্ক-এর ব্যবহারের পাল্লা প্রসারিত করার লক্ষ্য রয়েছে গবেষকদের, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহে। পলিসি নির্ধারণ থেকে শুরু করে আপৎকালীন পরিকল্পনা এবং উৎপাদন-শিল্প, যা-কিছুই নির্ভুল আবহাওয়া পূর্বাভাসের ওপর নির্ভরশীল, তাদের প্রত্যেকেরই সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়াকে বদলে দেবে এ আই-এর কর্মশক্তি। শুধু দ্রুতগতি তো নয়, আর্ডভার্ক-এর আসল দিগদর্শী কৃতিত্ব হল এর সহজসাধ্যতা। আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে সুপারকম্পিউটারের ক্ষেত্র থেকে বার করে ডেস্কটপের আওতায় এনে দেওয়ার ফলে পূর্বাভাস দেওয়ার কাজ এবার গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করবে। এইসব শক্তিশালী প্রযুক্তি এখন দুনিয়ার উন্নয়নশীল দেশসমূহ এবং ডেটার অভাবগ্রস্ত এলাকাগুলিতেও সুলভ হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 − 2 =