
বিজ্ঞানীরা বহুকাল ধরে পৃথিবীর বাইরে জীবনের ইঙ্গিত খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মঙ্গলের মিথেন গ্যাসের স্তূপ থেকে শুরু করে শুক্রের ফসফিন গ্যাসের মেঘ- সর্বত্রই চলছে সে অনুসন্ধান। সম্প্রতি সৌরজগতের বাইরের বৃহৎ গ্রহ K2-18b তে পৃথিবীর বাইরে জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এই গ্রহটি পৃথিবী থেকে ১২০ আলোকবর্ষ দূরের একটি নক্ষত্রের কক্ষপথে ঘুরছে। এই গ্রহের বায়ুমন্ডলকে বারবার বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে পৃথিবীর জীবিত প্রাণীর, যেমন সমুদ্র শৈবাল সদৃশ প্রচুর পরিমাণ অণুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং প্রধান গবেষক নিক্কু মধুসূদন বলেছেন, “তাই বলে এখনই আগেভাগে জীবন আবিষ্কার করা গেছে বলে দাবি জানানো ঠিক নয়”। গবেষক দলটি পর্যবেক্ষণ করেন, K2-18 নামের গ্রহটি একটি উষ্ণ মহাসাগর দ্বারা আবৃত যা প্রাণে ভরপুর। মধুসূদন জানান, “হয়তো এ এক বৈপ্লবিক মুহূর্ত! হতেই পারে এটি মানবজাতির বাসযোগ্য এক সম্ভাব্য গ্রহ যেখানে জীবনের চিহ্ন দেখার সুযোগ মিলেছে”। তবে এখনই তারা কোনো বড় সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাইছেন না। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহতত্ত্ববিদ স্টিফেন শ্মিডট বলেছেন, “এটি এমন কিছুই নয়। জীবনের দিক থেকে একটি ইঙ্গিত বহন করলেও, গ্রহটি মানুষের বাসযোগ্য কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলা অসম্ভব”। K2-18b তে বা অন্যত্র জীবন থাকলেও তার আবিষ্কার ধীরগতিতেই ঘটবে। প্রসঙ্গত, কানাডার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ২০১৭ সালে চিলির ভৌমিক দূরবীক্ষণ দিয়ে এই K2-18b গ্রহটি আবিষ্কার করেন। সৌরজগতের বাইরের এই গ্রহটি সাধারণ হলেও, পৃথিবীর কাছাকাছি অনুরূপ গ্রহ আর নেই, যাকে বিজ্ঞানীরা খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করতে পারবেন। এই ধরনের গ্রহকে উপ- নেপচুন বলা হয়ে থাকে। কারণ এগুলি সৌরজগতের পাথুরে গ্রহগুলির চেয়ে অনেক বড় কিন্তু নেপচুন ও অন্যান্য গ্যাসীয় গ্রহগুলির চেয়ে ছোট। ২০২১ সালে, ড: মধুসূদন এবং তার সহকর্মীরা বলেন, উপ- নেপচুন গ্রহগুলি উষ্ণ মহাসাগর দ্বারা পরিবৃত এবং এদের বায়ুমন্ডলে হাইড্রোজেন, মিথেন এবং অন্যান্য কার্বন যৌগ রয়েছে। এই অদ্ভুত ধরনের গ্রহগুলিকে বর্ণনা করার জন্য তারা ‘হাইশান’ (Hycean ) শব্দটি তৈরি করেন, যা ‘হাইড্রোজেন’ এবং ‘ওশান’ শব্দের সংমিশ্রণ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণের পর বিজ্ঞানীরা অন্যান্য দূরবর্তী গ্রহের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপের সুযোগ পান। সৌরজগতের বাইরের কোনো গ্রহ যখন তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যায়, তখন তার বায়ুমণ্ডল থাকলে সেটি আলোকে উদ্ভাসিত হয়। নক্ষত্রের অবস্থান সাপেক্ষে, এই উজ্জ্বলতার পরিবর্তন ওয়েব টেলিস্কোপে ধরা পড়ে। পরিবর্তিত তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বায়ুমন্ডলের রাসায়নিক গঠন অনুমান করেন। K2-18b পর্যবেক্ষণের সময় ডঃ মধুসূদন ও তার সহকর্মীরা দেখেন এতে ‘হাইশান ‘ -এর মতো অনেক অণু রয়েছে। ২০২৩ সালে তারা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অণুর মৃদু ইঙ্গিত পান- ডাইমিথাইল সালফাইড, যা সালফার, কার্বন এবং হাইড্রোজেন নিয়ে গঠিত। পৃথিবীতে ডাইমিথাইল সালফাইড -এর একমাত্র পরিচিত উৎস হল মহাসাগরের কিছু শৈবাল। এরা এই যৌগ তৈরি করে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। তা থেকেই সাগরের বিশিষ্ট গন্ধটি তৈরি হয়। অনেক আগে থেকেই জৈব বিজ্ঞানীদের ধারণার কেন্দ্রে ছিল এই ডাইমিথাইল সালফাইড। তারা বারংবার অনুসন্ধান করতে থাকেন, এটি অন্য গ্রহে জীবনের চিহ্ন হতে পারে কিনা! K2-18b যখন তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যায়, তখন বিজ্ঞানীরা অন্য যন্ত্র ব্যবহার করে গ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় আলো বিশ্লেষণ করেন। তারা শক্তিশালী সংকেত পান- ডাই মিথাইল ডিসালফাইড নামক অনুরূপ অণুর ইঙ্গিত। ” আমরা অনেক সময় ব্যয় করেছি সংকেতটি ভুল প্রমাণের জন্য”, ড: মধুসূদন জানান। কিন্তু যতবারই তথ্য পর্যালোচনা করেছেন ততবারই সংকেতটি আরো দৃঢ় হয়েছে। তাতে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, K2-18bএর বায়ুমন্ডলে প্রচুর পরিমাণ ডাইমিথাইল সালফাইড থাকতে পারে, এমনকি পৃথিবীর তুলনায় কয়েক হাজার গুণ বেশি! এ থেকেই অনুমান করা যায়, সেখানকার হাইসিয়ন সমুদ্র জীবনে পরিপূর্ণ। অন্যদিকে, ডঃ গ্লেইন ও তার সহকর্মীরা পাল্টা যুক্তি দেন যে K2-18b সম্ভবত একটি বিশাল পাথরের টুকরো যা লাভা মহাসাগর ও উত্তপ্ত ঘন হাইড্রোজেন বায়ুমন্ডলে পরিবৃত। এখন দেখার বিষয়, উপ-নেপচুনের সম্ভাব্য ডাইমিথাইল সালফাইড পৃথিবীর মতো আচরণ করে কিনা। নাসা একটি শক্তিশালী মহাকাশ দূরবীক্ষণ তৈরি করছে, যা অন্যান্য নক্ষত্রের চারপাশের কক্ষপথের গ্রহ, সেটা K2-18b -ও হতে পারে, তাতে বাসযোগ্যতার চিহ্ন খুঁজবে। হতেই পারে এভাবেই খোঁজ করতে করতে, ভিন গ্রহের প্রাণীএকদিন হাত নাড়া দিয়ে উঠল !