সৌর খামারে ভ্রমরগুঞ্জন

সৌর খামারে ভ্রমরগুঞ্জন

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৩ অক্টোবর, ২০২৫

ব্রিটেনের গ্রামাঞ্চলে এখন সূর্যের আলো কেবল ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ জোগাচ্ছে না, জীবনও জাগাচ্ছে। সোলার প্যানেলের নীচে জন্মানো বুনোফুলের সারিতেও প্রাণ ফিরিয়ে দিচ্ছে। এসব ফুল মধুর সন্ধানে আসা ভ্রমরদের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। এই মনোমুগ্ধকর সহাবস্থানে প্রযুক্তি ও প্রকৃতির বন্ধুত্ব নিয়ে গবেষণা করেছে ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজি এবং ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং-এর বিজ্ঞানীরা।

গবেষণায় দেখা গেছে, সৌর খামারগুলো যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে সেগুলো ভ্রমরদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিরাপদ আবাসে পরিণত হতে পারে। শুধু ছোট ঘাসের চাঁই না রেখে যদি চারপাশে বুনোফুলের সারি তৈরি করা যায়, তবে এ ধরনের মৌমাছির সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। ড. হলি ব্লেইডস বলেন, যথাযথভাবে ব্যবস্থাপিত সৌর খামারগুলো স্থানীয় ভ্রমর প্রজাতির টিকে থাকার জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে।

এই বুনোফুল, ঘাস ও খোলা জায়গার মিশ্র পরিবেশ ভ্রমরদের খাদ্য(ফুলের মধু), আশ্রয় (ঘাসের ফাঁকে বিশ্রাম),আর নিরাপদ প্রজননক্ষেত্র। অন্যদিকে, নিস্তরঙ্গ ঘাসের মাঠ তাদের কিছুই দেয় না। তাই সামান্য কিছু ফুলই পারে পুরো জীবজগৎকে জাগিয়ে তুলতে।

গবেষক দলটি কেবল বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের ছবিও কল্পনা করেছে। তারা ব্রিটেনের ১,০৪২টি সৌর খামারকে তিনটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ দৃশ্যপটে বিশ্লেষণ করেছেন— একটি টেকসই উন্নয়ন-নির্ভর, আরেকটি মধ্যপন্থী, এবং তৃতীয়টি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। উন্নত মানচিত্র ও ‘পরাগায়নকারী মডেল’-এর সাহায্যে দেখা গেছে , পরিবর্তিত ভূমি ও জলবায়ুর প্রেক্ষিতে ভ্রমররা কোথায় খাদ্য ও বাসা পাবে।

ফলাফলে দেখা গেছে, টেকসই ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে ফুল ও ঘাসে ভরা চারণভূমি ও পরিবেশবান্ধব কৃষিকাজ ভ্রমরের সংখ্যা বাড়ায়। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর ভবিষ্যতে শহর ও কৃষিজমি বেড়ে চলায় তাদের আবাস কমে যায়। তবুও, বুনোফুলঘেরা সৌর খামারগুলো আশেপাশে কিছুটা প্রাণ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

এই গবেষণায় আরও জানা যায়, সৌর খামারগুলো স্থানীয় পর্যায়ে জীবন ফিরিয়ে আনতে পারে, তবে একা তারা পুরো প্রজাতি রক্ষা করতে পারবে না। ফার্মের ভেতরে ভ্রমরের সংখ্যা বাড়লেও বাইরের এলাকায় তার প্রভাব দ্রুত ম্লান হয়ে যায়। তাই বৃহত্তর বাসস্থান পুনরুদ্ধার না করলে এই লাভ সীমিতই থাকবে।

প্রফেসর আলোনা আর্মস্ট্রং বলেন, এই সৌর খামারগুলো ভবিষ্যতের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এক নতুন হাতিয়ার হতে পারে, যদি আমরা সেগুলো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সাজাই। অর্থাৎ, চিত্রটা হবে অনেকটা এইরকম- এক মাঠ জুড়ে ছড়ানো সৌর প্যানেল, নীচে রঙিন ফুলে ঢাকা সবুজ গালিচা, আর তার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে শত শত ভ্রমর।

সঠিক পরিকল্পনায় সৌর প্রকল্পগুলো কৃষিজমি, তৃণভূমি ও বনাঞ্চলকে যুক্ত করবে। এতে পরাগায়নকারীরা সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবে।

 

এই গবেষণা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হল সৌর খামার কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্র নয়, এটি প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষারও ক্ষেত্র হতে পারে। যদি প্রতিটি সৌর খামারের নীচে ফুলের সমারোহ থাকে, তবে সূর্যের শক্তি শুধু গ্রিড নয়, মাটির জীবনকেও আলো দেবে।

যখন মানুষ প্রকৃতিকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহযোগী হিসেবে দেখে, তখন প্রতিটি ফুল, প্রতিটি মৌমাছি হয়ে ওঠে টেকসই ভবিষ্যতের দূত।

 

সূত্র: Solar Farms as Potential Future Refuges for Bumblebees by Hollie Blaydes, Alona Armstrong,et.al; published in the journal Global Change Biology,(8.10.2025).

https://doi.org/10.1111/gcb.70537

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 − 2 =